রোকেয়ার মিডল ক্লাস নারীশিক্ষা লইয়া কিছু হালকা পয়েন্ট

১.
নারীমুক্তি প্রশ্নে রোকেয়া কেন রোকেয়া? অবরোধবাসিনীদের মুক্তির কারণেই তো? এই অবরোধবাসিনীদের মুক্তির ব্যাপারটা কেবল মধ্যবিত্ত নারীদের প্রসঙ্গেই তোলা যাইতে পারে। গরীব নারীরা বাংলার অনেক অংশেই আগেও অবরোধবাসিনী ছিল না, এখনও নাই। আবার অনেক অংশে আগেও অবরোধবাসিনী ছিল, এখনও আছে।

সে অর্থে নারীমুক্তিরে রোকেয়াকরণ করতে গেলে মধ্যবিত্তের বাইরে যাওয়া যায় না।

বিদ্র: ওনার লেখালেখি যে ভালো সে বিষয়ে এখানে একেবারেই সন্দেহ করা হচ্ছে না।

২.
শিক্ষিত কইরা তোলার প্রশ্নে রোকেয়া সমগ্র নারীজাতির প্রতিনিধিত্ব করেন না।

রোকেয়া যখন নারী শিক্ষায় মন দিলেন তিনি মধ্যবিত্ত ঘরের নারীদের শিক্ষায় মন দিলেন। উনার শিক্ষা গ্রহণের জন্য তখনও সুপ্রচুর নারী পাওয়া যাইতে পারতো ছোটলোকদের মধ্যে। তিনি কি তাগোরে শিক্ষা দিছিলেন।… সেই আমলে ছোটলোকদের দিয়া বাসা বাড়ির কাজকর্ম চলতো। মধ্যবিত্ত নারীদের পাশাপাশি তাগোরে শিক্ষা দেওয়া যাইত না এমন না।

তাইলে রোকেয়া সচেতন ভাবেই ফকিন্নীগো বাদ দিয়া সহি মিডলক্লাস মেয়েদের শিক্ষিত কইরা গেছেন।

৩.
তখন ছোটলোকগো জন্য পুরুষ-নারী নির্বিশেষে আছে ‘নো শিক্ষা’। আর রোকেয়ার সমাজের পুরুষদের জন্য অলরেডি ‘আছে শিক্ষা’। ফলে রোকেয়ার কাজরে আমি গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে পারতাম যদি উনি অন্তত ছোটলোক বেডাগো শিক্ষার ব্যবস্থা কইরা যাইতে পারতেন। তা তো তিনি করেন নাই। ছোটলোক বেডিগো লাইগ্গাও না। কী নির্মম শ্রেণিস্বার্থ!

এইটা তো হইতেই পারে যে যা হয় নাই তা হয় নাই। তাইলে যা হয় নাই তা নিয়া কাউরে ভক্তি শ্রদ্ধা না দেখানোই ভালো।

৪.
ভাবতে গিয়া দেখলাম, রোকেয়ার স্কুলে মধ্যবিত্ত নারীরা পড়তে পারবে না, এমন কোনো নিয়ম ছিল না—তো তাইলে রোকেয়ার মহামহিম কামটা কী?

… যেই স্কুলে মধ্যবিত্ত নারীরা পড়তে পারবে সেই স্কুলে মধ্যবিত্ত নারীদের পড়ার ব্যবস্থা করা?…!!!

৫.
উনি ছোটলোক মেয়েদের স্কুলে না-আনার জন্যই চেষ্টা করছেন। হয়ত মধ্যবিত্ত সমাজের বনেদিয়ানা রক্ষার খাতিরেই সহজপ্রাপ্য ছোটলোক মাইয়াগো বিদ্যালয়ে ঢুকতে দেন নাই রোকেয়া। কী একদেশদর্শিতা!

এখন তো সন্দেহই হইতেছে। রোকেয়া বাসাবাড়ির চাকর মেয়েদের সঙ্গে কী আচরণ করতেন তা দেখা যাইতে পারে।

৬.
মধ্যশ্রেণী খারাপ না অবশ্যই। কেবল মধ্যশ্রেণীর উপকার করারেও খারাপ ভাবা হইতেছে না। শুধু, যখন মধ্যশ্রেণীরই উপকারার্থে কেউ জীবনপাত করতেছেন তারে সমগ্র নারী জাতির রক্ষাকর্তী ধরা ঠিক হবে না তাই বলা হইতেছে।

আজকে মধ্যশ্রেণীর শিক্ষিত নারীদের যে চারপাশে শিক্ষায় কলকাকলীময় দেখতে পাই তার জন্য রোকেয়ার কাছে আমরা পুরুষরা অবশ্যই ঋণী।

৭.
রেফারেন্সের অভাব নিজেই রেফারেন্স। রোকেয়ার স্কুলে ছোটলোকদের আগমনের বা কেন তাদের আনা হয় নাই বা গেল না সে রকম কোনো রেফারেন্স যে নাই আমার রেফারেন্স এইটাই।

আমি মহত্তের বিরোধী না। কিন্তু যা মহৎ নয় তাকে মহৎ বলতে চাই না। আর মহৎ ব্যক্তির ত্রুটি অনুসন্ধান আরেক মহৎ কাজ। কারণ তাতে প্রমাণিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে যে মহৎ মানুষটির ত্রুটি ছিল না। কিন্তু ইনার যে ছিল দেখতে পাই।

৮.
শ্রেণিবৈষম্য বজায় রাইখা লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার চেষ্টার নাম পুরুষতন্ত্র। পুরুষতন্ত্র কেবল পুরুষাঙ্গে বিরাজ না করার কারণে অনেক নারীই পুরুষতন্ত্রে অকাতর অবদান রাইখা গেছেন। রোকেয়া যেমন শিক্ষিত পুরুষদের ভোগের সামগ্রী হিসাবে শিক্ষিত নারীদের ব্যবস্থা কইরা দিয়া গেছেন। সেইটা রোকেয়ার পারিবারিক জীবন অবলোকন করলেই টের পাওয়া যাবে।

৯.
রোকেয়ারে নারীমুক্তির অবতার হিসাবে নিতে হইলে তিনি যে সচেতন ভাবে অনবরোধবাসিনী ছোটলোক মেয়েদের তার স্কুলের ছাত্রী হিসাবে দেইখাও দেখেন নাই সেইটা স্বীকার কইরা নিতে হয়। তা স্বীকার করলে রোকেয়ার নারীমুক্তির আন্দোলন গৌণ হইয়া যায় অনেকটাই। মহত্ত্ব তো দূরের ব্যাপার।

ছোটলোক নারীদের ব্যাপারে রোকেয়ার কার্যক্রম সরাসরিই। আর তা হইল আমার বিদ্যালয়ে আমি ছোটলোকদের নিমু না।… ছোটলোকদের স্কুলের বাইরে রাখার সিদ্ধান্ত রোকেয়ার সচেতন সিদ্ধান্ত।

১০.
ছোটলোকদের স্কুলের বাইরে রাখার ব্যাপারে রোকেয়ার সচেতন সিদ্ধান্ত অমানবিক। ক্ষুদ্র শ্রেণীস্বার্থ দ্বারা আবিল। এই কারণে তার মুসলমান নারীদের বা অবরোধবাসিনীদের উদ্ধার প্রকল্প আদতে প্রবলেমেটিক হইয়া গেছে।

১১.
অসচেতন সিদ্ধান্ত উদাসীনতা বা অসচেতনতা নির্দেশ করে। কাজেই রোকেয়া একই রকম অসুবিধার মধ্যেই থাকেন তাতে করে। মহত্ত্ব তার থেকে দূরে দূরে থাকে।

নারীদের মধ্যে শ্রেণীবিভেদ করার কারণে ব্যাপারটা অত্যন্ত মন্দ হয়েছে। রোকেয়ার পক্ষে আর সেই শ্রদ্ধা পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে না আমার এই আপত্তির পরে!

১২.
রোকেয়া যেই অধ্যবসায় সহকারে মধ্যবিত্ত কন্যাদের শিক্ষার তরে টানাহেঁচড়া করছেন সেই একই হেঁচরানি ছোটলোকদের জন্য করছিলেন এমন ইঙ্গিত কোত্থাও নাই। থাকলে আমি রোকেয়ার ব্যাপারে আমার আপত্তিখানা খারিজ করব।

১৩.
রোকেয়া যে ছোটলোকদের ওনার স্কুলে আনার জন্য চেষ্টিত ছিলেন সেই রকম কোনো দৃষ্টান্ত নাই। মধ্যবিত্ত মাইয়াগো আনার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। (যদি এইটা উনি না করতেন তারও দৃষ্টান্ত পাওয়া যাইত না।) এবং উনি কত কষ্ট কইরা এই মাইয়াগো জড়ো করছেন তার কাদুনি গাওয়া হয়। করেন নির দৃষ্টান্ত থাকব কেমনে? যা করেন নাই তার তো দৃষ্টান্ত হয় না।

রোকেয়ার বাসায় বা তার সমকালীনগো বাসাবাড়িতে কামের বেটির যদি অভাব না থাকে তাইলে ছোটলোকের বাচ্চাদের স্কুলে আনতে না পারাটারে কেবল সীমাবদ্ধতা বললে হবে না। উনি ছিলেন গড় মাপের মানুষ। তারে সেভাবে দেখাই কর্তব্য।

১৪.
ফলশ্রুতির দিকে যাইতে থাকলে নারীশিক্ষা হইছে পুরুষ শিক্ষার ফলশ্রুতিতে। সে অর্থে “আজকে অনেক নিম্নবিত্ত নারীই শিক্ষিত হচ্ছে” সেই পুরুষ শিক্ষারই ফলশ্রুতিতে। ফলারম্ভ আমি রোকেয়া থিকা ধরুম কেন!


‘নারীমুক্তি প্রশ্নে রোকেয়া কেন রোকেয়া’ (মার্চ ২০০৯) নাম্নী একটা এফবিনোট থিকা এই লেখার উৎপত্তি। নোটের কমেন্টাংশে অন্যদের সঙ্গে আলাপ করতে গিয়া পয়েন্টগুলা উইঠা আসছে। ফলত এইখানে বেহাজির রাখা সেইসব কমেন্টের অবদান স্বীকার করতেছি এই লেখায়। 

Leave a Reply