আলজিভের প্রকটন

কবিতাকথা গুগল গ্রুপে প্রেরিত সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের একটি চিঠিকে (এপ্রিল, ২০০৯) লক্ষ্য করে… 

সুব্রত,

তুমি লিখছ:

‘আমাকে তাও একেবারে চাঁচাছোলা গালি দেওয়া হয় নি, রাইসুকে তাও খেতে হয়েছে, অনেক ছোটদের কাছে। কেন? কোন অধিকারে? মানে অধিকারের প্রশ্ন ওঠে যদি। রাইসু কোনো এক কবিতা “গোয়া মারে” লিখেছে তাই তাঁর আজীবনকাল লেখা সব কবিতা বাতিল হয়ে গেল!’

তো তুমি শূন্য দশকের দুইমাত্র ইজারাদারের লগে সাহিত্যের আলাপ করতে বসছো, করো। আরো শূন্য আছে। কিন্তু আমার কবিতারে ‘কোনো এক কবিতা “গোয়া মারে” লিখেছে’ বললা কী মনে কইরা? বলতে মানা করতেছি না। তথাপি যেই কবিতার কুলশীল আছে (দোরা কাউয়া পেয়ারা গাছে, আকাশে কালিদাসের লগে মেগ দেখতেছি, পৃষ্ঠা ৬৩; ২০০১) তারে কোনো এক কবিতা বলা কি ঠিক?

তুমি কি মনে করো কেউ যদি খারাপস্য খারাপ কবিতাও লেখে তার জন্য কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয়? তো আমি যদি জবাবদিহি না করব, তুমি কেন করতেছো? মানে ঠিক কী কারণে এই কবিতা নিয়া নাদান পাঠক আপত্তি তুললে তোমার জবাবদিহি করতে হয়? তুমি তুলনামূলক আলোচনায় ঢুকলা—যেন এই কবিতা লিখলে অন্য কবিতা বাতিল হবে না বটে কিন্তু এইটা একটা খারাপ কবিতা! তুমি তারিক টুকু এবং সোহেল হাসান গালিবের একটা কবিতা দেখাও যেই কবিতা আমার এই ‘গোয়া মারা’ কবিতার চাইতে কোনো দিক দিয়া ভালো। তারা নিজেরা ভালো বলবেন সে আমি জপমুনে নাইলে… কিন্তু সত্য সত্য বলো তো এই ‘দোরা কাউয়া পেয়ারা গাছে’র কাছাকাছি আইতে পারে এমন কবিতা ওনারা দুইজনের কেউ লেখছেন?

শূন্য দশকের অন্তিম কাল চইলা আসছে। আট মাস বোধহয় পইড়া আছে পাথারে! নিতান্ত দেরি হইয়া গেল। দশকের ইজারা দখলের পায়তারা চলিতেছে শূন্যে। কয় দিনের মইধ্যেই যার যার নিজের নিজের কবরে ঘাস বিছায়া শুইয়া পড়তে হবে। পরবর্তী দশক তো আইসা গেল বইলা। সেইটা আমি বুঝি। তা নিয়া আমার অলেখকসুলভ স্নেহাদিও আছে। যাদের দরকার কোরামিন তাদের তুমি আচরণবিধি ঠুসতেছো!।

বলতেছো:

“আমরা আমাদের ইমিডিয়েট প্রেডেসেসর, মানে সত্তরের মেইনস্ট্রিম কবিদের মতো লিখব না পণ করে লেখা শুরু করেছিলাম, কিন্তু আমাদের কেউই কখনো তাঁদেরকে গালাগাল দিয়েছে বা ভার্বালি রেফিউট করেছে, এমন মনে করতে পারছি না। আমরা তাঁদের থেকে আলাদা রকম লিখতে চেয়েছি, যে যার মতো, কতটা সফল হয়েছি সেটা অন্য বিচার। কিন্তু তাঁদেরকে গায়ে পড়ে অসম্মান করি নি।”

যাগোর খুঁতিতে আর সময় বলতে নাই নিজেগো মুদ্রায় নিজেগোরে চিনা নেওয়ার তারা যদি আগের দশকের কাউরে অসম্মান কইরা ইতিহাসে এট্টু জায়গা পাইতে চায় তা করতে দেয়া উচিত। তা না তুমি ছোট ভাইগোরে নীতিশিক্ষা দিতে বসলা? ওনাদের কবিতা তো তুমি পছন্দই করো জানতাম! তইলে ওই দিয়া কী ঘোড়ার ডিম হবে তা তো তুমি বোঝোই। এই হাতের মোয়া অসম্মান ছাইড়া দিতে হইলে ওনারা আর কী নিয়া দশকময় হইয়া থাকবেন তখন?

ধরো একটা কবিতা কবিতা পদবাচ্য হইছে, তায় নতুন ধরনের, ইহ জগতে আগে এমনটা আর লেখা হয় নাই—এঁরা কেউ তেমনটা লিখছেন বইলা তোমার মনে হয়? তা যদি না হয় তবে শূন্য কেন তিন হাজার সালের পরবর্তী শূন্য দশকের কবির লগেও বাতচিতে ভেরেণ্ডা ভাজার বেশি কিছু হবে না। তুমি নিশ্চয়ই শূন্য দশকের ফাঁপা কোনো কবির চাইতে (শূন্য দশকের অ-ফাঁপা কবিদের তালিকাও তখন তোমার দিতে হবে, হায়!) ফরহাদ মজহার, জয় গোস্বামী বা নিদেন মুজিব মেহদীর (আমি ওনারটা পড়ি নাই এখনো) এখনকার লেখাই বেশি পছন্দ করবা। সেইটা তোমার কথায় বোঝা যাইতেছে না। মনে হইতেছে তুমি মাসুদ খানের লাইন ধরছো। তরুণ প্রাণ গড়ের মাঠদের সম্ভাবনার সইলতা টাইনা টাইনা বাইর করার চেষ্টা করতেছো। ওইটা আলজিব্বা, বেশি টানলে শূন্যগর্ভ প্রকট হইব মাত্র!

আমি তো মহাত্মা (সলিমুল্লাহ খান থিকা ধার করলাম) সেলিম আল দীনের লেখাই পড়তে পারি না। সেলিম এবং তদবর্তীরা নিকষিত মধ্যযুগ পুননির্মাণে মরীয়া হইয়া উঠছেন। গরীব দেশে এমন হয়। অরিয়েন্টালিজম বইয়ের বদহজম বাংলা সাহিত্যরে এক অন্তসারশূন্য সচেতন পাঠক সমাজ উপহার দিয়া গেছে—তুমি গোয়ারক্ষা, ভাষারক্ষা আর সমাজরক্ষায় তাদের সহযাত্রী হইও না—এই নিবেদন করি। তোমার বা আমার মত বড় কবির পাঠক হইতে পারাই ওনাদের জন্য যথেষ্ট। আর এঁদের লেখাও এক সময় নিশ্চয়ই আমি পইড়া উঠতে পারব। ততদিন… বাচ্চালোগ তালিয়া বাজাও, গাইল পারতে থাহো!

– ব্রাত্য রাইসু, ঢাকা ২০/৪/২০০৯

***

 

২. কবিতাকথা গ্রুপে সুব্রতর চিঠি

প্রিয় টুকু,

অনেক দিন যাবত্ আমি চুপ করে আছি এ-সভায়, প্রধানত সময়াভাবে, আর আমি বুঝতে পারছিলামও না আমার কথা বলার হক এখানে আসলেই আছে কীনা, মানে আমাকে এর সদস্য হয়তো বানিয়ে থাকা হতে পারে শুধু কথা শোনবার জন্য, শোনাবার জন্য নয়।

এই ত্রিভুজ প্যাড-এ বাংলা লেখা কী যে ঝক্কি!

এখন এক সপ্তার ছুটিতে আছি, হয়তো লেখা যায়। তাই লিখছি। আর আপনার এই চিঠিটা হঠাত্ নজর কাড়লোও বটে। বিশেষ করে: “আমি বলতে চাইছি এই যে ভাষ্কর আবেদীন হঠাৎ করে শূন্যদশকের কবিদের কুয়ার ব্যাঙ বলে দিলেন, তো তিনি তা বলার অধিকারই রাখেন না যদি না তার গল্প/কবিতা বা সাহিত্যের অন্য কোনো শাখায় কোনো কন্ট্রিবিউশন না থাকে। এমন কোনো কন্ট্রিবিউশন তার আছে বলে আমি জানি না, যে কারণে তার কন্ট্রিবিউশনের কথা জানতে চাইছিলাম।”

কন্ট্রিবিউশন থাকা-না-থাকার উপর মতামত দেবার অধিকার নির্ভরশীল হয় যদি, টুকু, তাহলে, কন্ট্রিবিউশনের বেশকমের উপর সেই অধিকারের বেশকমও হবে তো, না কি? এই গ্রুপ-এর একেবারে বিসমিল্লাহ নাগাদ, আমাকে আর রাইসুকে আশরাফ শিশির যে-ভাষায় আক্রমণ করলেন (এবং তাঁর কোনো কথাতেই স্পষ্ট হল না তাঁর ক্ষোভটা আসলে কোথায়, মানে তাঁকে তাঁর ইচ্ছামাফিক পাত্তা না-দেওয়া ছাড়া আমাদের দু’জনের অপরাধ কী ছিল বোঝা গেল না), বা স্রেফ অর্ধেক লাইনে গালিব আমাকে আর কামুকে ব্যর্থ কবির রায় দিয়ে দিলেন, এবং তার ল্যাজ ধরে আপনি আমার গত কয়েক বছরের সব লেখাকে উড়িয়ে দিলেন, আপনার এই কন্ট্রিবিউশন তত্ত্বকে মান্য করলে, আমি কিন্তু আপনাদের তিনজনেরই কন্ট্রিবিউশন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারি। পারি না?

মানে এই যে এক কথায় উড়িয়ে দেবার যে প্রবণতা আপনার এবং আপনার বন্ধুদের মাঝে দেখতে পাচ্ছি, এটা যদি ব্যাকফায়ার করে কখনোসখনো, তাতে এত রাগান্বিত হবার কিছু নাই। আপনারা হয়তো ভাবছেন আমাদের খারিজ করাটা জরুরি, নিজেদের আলাদা স্বরের প্রতিষ্ঠার জন্য। তা যদি হয়ও, খারিজটা কিন্তু প্রধানত লেখা দিয়েই করতে হবে, মুখের কথায় হাতিঘোড়া মেরে নয়। আমরা আমাদের ইমিডিয়েট প্রেডেসেসর, মানে সত্তরের মেইনস্ট্রিম কবিদের মতো লিখব না পণ করে লেখা শুরু করেছিলাম, কিন্তু আমাদের কেউই কখনো তাঁদেরকে গালাগাল দিয়েছে বা ভার্বালি রেফিউট করেছে, এমন মনে করতে পারছি না। আমরা তাঁদের থেকে আলাদা রকম লিখতে চেয়েছি, যে যার মতো, কতটা সফল হয়েছি সেটা অন্য বিচার। কিন্তু তাঁদেরকে গায়ে পড়ে অসম্মান করি নি। কবি হিসাবে ব্যর্থ যদিও হয়ে থাকি, মানুষ হিসাবে খানিকটা মর্যাদা আশা করতে পারতাম হয়তো আমরা।

আমাকে তাও একেবারে চাঁচাছোলা গালি দেওয়া হয় নি, রাইসুকে তাও খেতে হয়েছে, অনেক ছোটদের কাছে। কেন? কোন অধিকারে? মানে অধিকারের প্রশ্ন ওঠে যদি। রাইসু কোনো এক কবিতা “গোয়া মারে” লিখেছে তাই তাঁর আজীবনকাল লেখা সব কবিতা বাতিল হয়ে গেল! আর এসব ফালতু কথা যারা বলে, তাদের কথা আপনাদের কানে লাগে না, তো ভাস্করের কথা কেন লাগছে? কন্ট্রিবিউশনের কথা বলেন যদি, আমার জানামতে ভাস্কর কবিতা লেখেন, এবং তাঁর কবিতা আমার প্রায়শ ভালো লাগে, এবং আমার জানাশোনার কথা বললে, এযাবত্, তাঁর কন্ট্রিবিউশন যে আপনার চেয়ে খুব বেশি কম, তা মনে হয় না।

আমি ঠিক আপনাকে আঘাত করবার জন্য বলি নি এসব। আশা করি পার্সোনালি নেবেন না।

সুব্রত।

 

Leave a Reply