মহৎ সাহিত্য, বর্ণবাদী সাহিত্যের একটি শাখা

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এই কয়জনের নাম আমি জানি গল্পকার-ঔপন্যাসিক হিসাবে। তারা মহৎ।

কিন্তু এই রকম আরো অনেক গল্পকার-ঔপন্যাসিক আছেন দেশে, ভারতে ও বিদেশে। যারা একান্তই মিডল ক্লাস গল্পকার-ঔপন্যাসিক।

মিডল ক্লাস শ্রেণি অবস্থান থিকা রেসিস্ট সাহিত্য রচনা কইরা গেছেন, করতেছেন ও করবেন।

২.
আমি যেই সাহিত্যিক দোষের কথা বলবো তা যে এই কয়জনের সবারই আছে এমন নাও হইতে পারে।

যেহেতু আমার পড়া কম ও স্মৃতি থিকা বলতেছি, সবার ক্ষেত্রে আমার এই অভিযোগ প্রযোজ্য হবে না।

তাতে আসলে কার দোষটি আছে, কার বা নাই সেই জিনিস মিলাইতে গিয়া সময় নষ্ট কইরেন না আপনারা।

আমি একটা ধরনের সাহিত্যিক বিচার-বিবেচনার ঐতিহাসিক দোষ বা অসঙ্গতি ধরাইতে চাইতেছি।

ওইখানে থাকেন।

৩.
বাস্তববাদী সাহিত্য, কম্যুনিস্ট সাহিত্য বা মহৎ সাহিত্য যারা করেন তারা আসলে কী করেন?

বা এই সাহিত্যগুলি আসলে কী জিনিস?

আমার বিনীত অভিযোগ হইল, তারা আসলে মিডল ক্লাস শ্রেণি অবস্থান থিকা এসবের নামে একটা বর্ণবাদী ধারার সাহিত্য রচনা করেন।

বর্ণবাদী সাহিত্যেরই শাখা সাহিত্য ‘বাস্তববাদী সাহিত্য’, ‘কম্যুনিস্ট সাহিত্য’ ও ‘মহৎ সাহিত্য’।

৪.
যেই মিডল ক্লাস স্বাভাবিক অবস্থার সময় বা এমনকি দুর্ভিক্ষের সময়েও গরিবরে হেল্প করে না, সেই মিডল ক্লাসের গরিব হইয়া যাওয়ার আশঙ্কার গল্প লেখেন তারা, মহৎ সাহিত্যের ভঙ্গিমায়।

যে মহৎ সাহিত্য তারা রচনা করেন সেই সাহিত্যগুলির ভাইটাল পয়েন্ট হইল, মিডল ক্লাসের গরিব হওয়ার বা অস্বচ্ছল হওয়ার কারণে যে সম্ভাব্য ও বর্তমান অসম্মান সেইটারে মহৎ উপায়ে হাজির করা।

দুনিয়ায় যে লক্ষ কোটি গরিব বিরাজ করে, তাদের গায়ে খাইটা কাজ করতে হয় ওনাদের সাহিত্য কিন্তু তাদের স্বাভাবিক ও নিত্যদিনের ‘অসম্মান’ লইয়া না। বরং মিডল ক্লাসের যদি এই কাম করতে হইত তাইলে কত খারাপ হইত, সেইটা।

গরিব নিয়া যত সাহিত্য আছে সবই এই ছদ্মবেশি মিডল ক্লাস হায় হায় সাহিত্য—হায় আল্লাহ, মিডল ক্লাস যদি গরিব হইয়া যায়, কত দুঃখ হবে, কত অসম্মান হবে, ইত্যাদি।

৫.
ধরেন দেশে প্রচুর বেশ্যা আছে, কিন্তু মিডল ক্লাস ফ্যামিলির কোনো মেয়েরে যদি বেশ্যাগিরিতে ঢুকতে হয় তাইলে সেইটা যে কতটা অসম্মানের, দুঃখের হবে আপনারা জানেন। মিডল ক্লাস এই সাহিত্যিকরাও তা জানেন এবং তাদের সাহিত্যে একই কথা প্রকাশ ও প্রচার করেন।

আমি বলতেছি না, আমাদের মিডল ক্লাসের একটা মেয়ের বেশ্যা হইয়া যাওয়ার গল্প পইড়া আমরা বেদনার্ত ও দুঃখিত হবো না।

অবশ্যই হবো। যেমনটা আমরা হই, হাসান আজিজুল হকের মহৎ গল্প ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ পইড়া।

আমার অভিযোগ হইতেছে, সাহিত্যে এই দুঃখ ও অসম্মানের মহত্ত্ব গরিব ফ্যামিলি থিকা আসা বেশ্যা জনগোষ্ঠীর দুঃখ আর অসম্মানরে অস্বীকারের মাধ্যমেই মহৎ হইয়া ওঠে।

যে গরিব তরুণীটি ইতিমধ্যে বেশ্যা হইয়া আছে তার দুঃখ আর অসম্মানরে গণনা করতে গেলে ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’-এর মহত্ত্ব আর মহৎ থাকতে পারে না।

তা বিশেষ হইতে পারে না বিধায় মহৎও হয় না।

৬.
মিডল ক্লাস যে গরিবের মত হইয়া যাইতেছে এই ভয়ই দেখান মহৎ সাহিত্যিকরা হরেদরে তাদের ‘বাস্তববাদী’, ‘কম্যুনিস্ট’ ও ‘মহৎ’ গল্প উপন্যাসে। অন্য সাহিত্যিক ও মিডল ক্লাস পাঠক-পাঠিকাই তাদের গন্তব্য।

তো এই হচ্ছে মহত্ত্ব। মহৎ সাহিত্য।

মিডল ক্লাসের কোনো সদস্যের দ্বারা গরিবের নিত্য কাজটি মাত্র একদিন করতে হইলেই বিশাল মহৎ সাহিত্য যে রচিত হইয়া যায়, এর কারণ কী?

৭.
ধরেন আপনি একজন মিডল ক্লাস। আপনি বলতে আপনি হইলেন মিডল ক্লাস কোনো একটা রাইটারের যে কোনো একটা চরিত্র। আপনার বাপ পয়সার টানাটুনিতে পইড়া রিকশা চালাইতে শুরু করছে, যে রিকশা লক্ষ লক্ষ গরিবে চালায়। তো তা কেন মহৎ?

গরিবের এই রিকশা টানার স্বাভাবিকতা কেন মিডল ক্লাসের জন্য অসম্মানের?

এখানেই আসে বর্ণবাদের প্রশ্ন।

মিডল ক্লাসের এই অসম্মানের বোধ হইল গরিবের প্রতি মিডল ক্লাসের বর্ণ বিদ্বেষের বোধ।

এইটা থাকবেই। এই জিনিস না থাকলে মিডল ক্লাসও থাকবে না।

কিন্তু সাহিত্যিক হিসাবে এই অসম্মানের বোধরে যত মহৎ করতেছেন ততই মানব বিরোধী সাহিত্যিকে পরিণত হইতেছেন আপনি।

আপনি স্রেফ অপরিণত একজন গল্পকার বা ঔপন্যাসিক থাইকা যাইতেছেন ও সে হিসাবে মারা যাইতেছেন।

১৯/৭/২০২১

Leave a Reply