ছফা ভাইয়ের ভাতিজা নূরুল আনোয়ারের সঙ্গে আমার অনেকবারই দেখা-সাক্ষাৎ হইছে, সেই আমলে ছফা ভাইয়ের বাংলা মোটরের বাসায়। ছফা ভাইকে যেই রকম ভাই ডাকতাম নূরুল আনোয়ারকেও আমি ভাইই ডাকতাম।
সম্প্রতি ছফা ভাইয়ের ভাতিজা নূরুল আনোয়ার আমার ছফা বিষয়ক বিবিধ সমালোচনাকে বেশ্যাবৃত্তি ও ধান্ধাবাজির সঙ্গে তুলনা করছেন।
আমি তাকে সহনশীল হইতে অনুরোধ করবো। বলব যে, পারিবারিক আপত্তির জায়গা থেকে সাহিত্য সমালোচনাকে নেওয়ার কিছু নাই।
মনে রাখতে হবে, ছফা যত না তার ভাতিজার সম্পত্তি তার চাইতে বেশি সাহিত্য সমাজের অংশ। এবং জীবিত অবস্থায় যিনি ঘনিষ্ঠ ছিলেন সে সাহিত্যিককে মৃত্যুর পরে আর সমালোচনা বা নিন্দা করা যাবে না সাহিত্য বিষয়টি এমন নয়।
মি. নূরুল আনোয়ার ফেসবুকে আমার বিষয়ে একটি নোট লিখছেন। যার উত্তর দেওয়া আবশ্যক জ্ঞান করলাম।
প্রথমে নূরুল আনোয়ারের নোট ও পরে আমার উত্তর।
১. নূরুল আনোয়ারের নোট:
————————————
হুমায়ূন অাহমেদ যে মাপের লেখক হোক না কেন তথাকথিত লেখকদের মধ্যে একটা ঈর্ষার জায়গা তৈরি হয়েছিল, একইভাবে অাহমদ ছফার বেলায়ও একই কথা খাটে। তার জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে ব্রাত্য রাইসুরা। অাহমদ ছফা যদি এত গৌণ লেখক হন তাহলে রাইসু অাহমদ ছফার পায়ের কাছে বসে থাকতেন কেন? তার কী দরকার ছিল অাহমদ ছফার সাক্ষাৎকার গ্রহণে? নিশ্চয় তার কোন বদ উদ্দেশ্য ছিল। এখনও তিনি অাহমদ ছফার সাক্ষাৎকার বই অাকারে বের করে বেচা বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়ে চলেছেন, তাতে কি নিজেকে ধান্ধাবাজ মনে হয় না? অাহমদ ছফা মারা যাওয়ার পর রাইসু অতি যত্নসহকারে অামার “ছফামৃত” বইটি ধারাবাহিক ছাপেন। তিনি অামার কাছ থেকে অাহমদ ছফার সকল ছবি নিয়ে স্ক্যান করে নেন। তারপর অাহমদ ছফা নামে ফেসবুকে অাইডি খুলে ওগুলো একের পর এক লোড করতে থাকেন। তারও অাগে ব্রাত্য রাইসু অামার কাছে এক তরুণকে পাঠান “মরণ বিলাস” উপন্যাসটি সিনেমা করার জন্য দেনদরবার করতে। এখন বলছেন অাহমদ ছফা কোন ঔপন্যাসিকও না। অাহমদ ছফা কোন মানের লেখক নয়। অাহমদ ছফা লেখক কি অলেখক ওসব অামাকে ভাবায় না। যেকোন লেখককে নিয়ে সমালোচনা হতেই পারে। তাই বলে এক লাইনের দু লাইনের কথা ছুড়ে দিয়ে চুলকানো তো বেশ্যার নামান্তর। অাহমদ ছফাকে নিয়ে বিস্তারিত লিখে সমালোচনা করুক সেটা অামরাও চাই।
ব্রাত্য রাইসু অামার বন্ধু প্রজাতির একজন। অামার শুভাকাঙ্ক্ষীও। বছর কয়েক অাগে তার সঙ্গে অামার ফেসবুকে কিছুটা তর্ক হয়। অামি একটা স্যাটাস দিয়েছিলাম, অামি জ্ঞানী হতে চাই। অাপনারা অামাকে কিছু জ্ঞান দেবেন? তখন ওখানে ব্রাত্য রাইসু লিখলেন, অাহমদ ছফার কোড ব্যবহার করেন?
তখন অামি অাহমদ ছফার দুটি কোড ব্যবহার করেছিলাম। এক, শূয়োরের বাচ্চার দাঁত গজালে বাপের পাছায় কামড় দিয়ে শক্তি পরীক্ষা করে; দুই, এক কানকাটা রাস্তার এক পাশ দিয়ে হাঁটে, দুই কানকাটা রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটে। তখন তিনি কোন জবাব দিতে না পেরে বললেন, অাহমদ ছফা অামার গুরু ছিল না তো!
অামি বললাম, গুরু ছিলেন কিনা অামি বলি না। পা চাটার মতো অাহমদ ছফার পিছনে পিছনে ঘুরতেন। একটা কথা শোনার জন্য কান পেতে থাকতেন। এখন রাইসু বলতে পারেন, অাহমদ ছফার কোথায় দোষ ছিল সেটিই খুঁজে বার করতাম। তাহলে অামাকে অাহমদ ছফার ভাষায় বলতে হয়, বিশেষ জায়গায় অাঙুল না দিলে সুখ পান না তাই না?
ধান্ধাবাজির একটা সীমা থাকে। বিশেষ জায়গায় নতুন কিছু গজালে ধরে ধরে দেখে, অার ভাবে বিশেষ কিছু হয়ে গেছি। রাইসু বিশেষ কিছু হয়ে গেছেন। মুষিক যতই পর্বতের ছিদ্রান্বেষণ করুক না কেন পর্বত অাপন মহীমায় দাঁড়িয়ে থাকে, তাতে কিছুটা কাতুকুতু লাগে বটে, কিন্তু মজাই পায় ঢের বেশি। ব্রাত্য রাইসুকে বলি, অাপনাকে সম্মান করি, সেই সম্মান নিয়ে থাকার চেষ্টা করুন। বিশেষ জায়গায় অাঙুল দিলে সুখ পাবেন বটে, কিন্তু তার গন্ধের ভয়াবহতাও কম নয়।
— নূরুল আনোয়ার, ১১ জুন ২০১৮
২. আমার বক্তব্য :
————————-
আহমদ ছফার উপন্যাসকে আমি যেভাবে দেখি তা নিয়া আমার ৬/১২/২০১৩ তারিখের লেখাটি ছিল এই রকম:
“আমাদের দেশে ভালো ঔপন্যাসিকের দৃষ্টান্ত দিতে গেলে অনেকেই আহমদ ছফা বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের দৃষ্টান্ত দেন।…
তবে আমার বিনীত অনুরোধ, ছফা বা ইলিয়াস ভালো ঔপন্যাসিকের দৃষ্টান্ত হইতে পারেন না—তাদের চেয়ে ভালো ঔপন্যাসিক যেহেতু ছিলেন।
তারা দুইজনই ধরেন ঔপন্যাসিক হিসাবে রশীদ করীম বা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর চাইতেও কম ভাল। ভালো হিন্দু ঔপন্যাসিকদের নাম না নিয়াই বললাম। বলা যায় এই দুই মুসলমান ঔপন্যাসিক ছিলেন সম্ভাবনাময় লেখক। ভালো ঔপন্যাসিক তারা হইতে পারতেন। বয়স পান নাই বইলা তারা এখন ছাড়যুক্ত ভালো ঔপন্যাসিক হিসাবে বিরাজিত আছেন। মৃত্যুর কারণে কঠিন সমালোচনাও হয় না আর তাদের।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তো—তার উপন্যাসের কথা ভাবলে—নিরীক্ষাধর্মী লেখক হিসাবেই গত হইছেন বলতে হয়। আর আহমদ ছফার ভালো উপন্যাস যেইটা—বাকি উপন্যাসগুলার অবস্থা আরো কম ভালো—’পুষ্পবৃক্ষ ও বিহঙ্গপুরাণ’ (১৯৯৬)—তা পরিবেশবাদ বা অন্য কিছু গৌণ কারণে ভালো বইলা প্রতিভাত হইতে পারে। এমনিতে উপন্যাস হিসাবে গৌণ।”
তো দেখা যাইতেছে নূরুল আনোয়ারের অভিযোগ সত্য নয়। আমি এই কথা বলি নাই যে “অাহমদ ছফা কোন ঔপন্যাসিকও না। অাহমদ ছফা কোন মানের লেখক নয়।”
আমার কথা হচ্ছে “ছফা বা ইলিয়াস ভালো ঔপন্যাসিকের দৃষ্টান্ত হইতে পারেন না—তাদের চেয়ে ভালো ঔপন্যাসিক যেহেতু ছিলেন।”
নূরুল আনোয়ার আরো বলতেছেন, “যেকোন লেখককে নিয়ে সমালোচনা হতেই পারে। তাই বলে এক লাইনের দু লাইনের কথা ছুড়ে দিয়ে চুলকানো তো বেশ্যার নামান্তর।”
আমি এ বিষয়ে আর কী বলবো! এনএ সাহেবের বেশ্যানিন্দা বিষয়ে আমার কিছু বলার নাই।
তিনি আরো বলতেছেন, “পা চাটার মতো অাহমদ ছফার পিছনে পিছনে ঘুরতেন। একটা কথা শোনার জন্য কান পেতে থাকতেন।”
এই তথ্য অনৈতিহাসিক। ছফা ভাই কখনো শাহবাগে আড্ডার পরে তার বাসায় নিয়া যাইতেন, কখনো আমরা নিজেরা যাইতাম। তিনি আমাদেরকে সম্মানিত অতিথির মর্যাদা দিতেন। চা এর সঙ্গে দুই চামুচ কইরা ব্র্যান্ডি খাওয়াইতেন মাঝে মাঝে। আর প্রায় সময়ই কাটা পনির আসত টেবিলে। পা চাটানোর মত নিচু মানসিকতা আহমদ ছফার ছিল না। আমরা তার হাত বা পা চাটি নাই কখনোই। এমনিতেই এগুলি খাইতে দিতেন তিনি।
তবে একটা বিষয়ে আমার সব সময়ই আপত্তি ছিল। কেন ছফা ভাই তার ভাতিজা নূরুল আনোয়ারকে আমাদের সঙ্গে আড্ডায় ডাকতেন না।
আমি মনে করি এইটা ছফা ভাইয়ের ক্রুয়ালিটির অংশ। সর্বদা একই বাসায় অবস্থান করা নূরুল আনোয়ারের প্রতি অন্যায় আচরণ ছিল এটি। সম্ভবত ছফা ভাই একের অধিক বার নূরুল আনোয়ারকে বাসা থেকে বিতাড়িতও করছিলেন। সঠিক তথ্য জানি না।
আমি ছফা ভাইয়ের এই ফিউডাল রূপটিকে অপছন্দ করতে চাই, যদি নূরুল আনোয়ার ভাই আমাকে অনুমতি করেন।
— ব্রাত্য রাইসু, ২২ জুন ২০১৮