চা পাতার দাস

চা শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি দিতে হবে, নাইলে আপনি প্রতি কাপ চায়ের সঙ্গে শ্রমিকের রক্ত পান করতেছেন—এই টাইপের রোমাণ্টিক দৃষ্টিভঙ্গি চা শ্রমিকদেরকে চা শ্রমিক হিসাবেই বন্দি রাখবার করুণামূলক দৃষ্টিভঙ্গি।

চা শ্রমিকরা কেন চা বাগান ছাইড়া যেই পেশায় বেশি পয়সা তা এক্সপ্লোর করতে পারে না, সেই ব্যাপারে মনোযোগ না দিলে আপনি চা শ্রমিকদের টাকা বাড়াইয়াও শেষ পর্যন্ত দাসশ্রমিক হিসাবেই তাদেরকে ধইরা রাখার সম্মতিপত্র দিতেছেন।

বরং চা শ্রমিকরা যদি দেশে বর্তমান অন্য সব কাজে অংশগ্রহণ করে, চা বাগান ও বন্দিত্বের রোমাণ্টিক এলাকা ত্যাগ করে, তবে এই দাসজীবন তার আর থাকেও না।

২.
বংশানুক্রমে কোনো পেশায় নিযুক্ত থাকলে মালিকের দাস না হইলেও সেই পেশার দাসই সে মানুষ হয়।

তারা কেন চা বাগান ছাড়ে না, দেখা দরকার সেই বিয়ষটি।

চা শ্রমিকরা সারাজীবন চা শ্রমিকই থাকবে এইটা দাসপালন মূলক মনোভাব।

চা শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা করার চিন্তা ১৪৫ টাকা করার চাইতে খুব বেশি আনন্দজনক বা ভবিষ্যৎময় নয়। বরং ৩০০ টাকা মজুরি হইলে এই দাসশ্রমিকরা আরো বেশি দাসই থাইকা যাওয়ার মধ্যে থাকতে থাকবে।

৩.
চা শ্রমিকদের চা বাগান ছাড়ার কথা বলাতে মিডল ক্লাস চা খাওয়া লোকগুলা দেখলাম তেলেবেগুনে জ্বইল্লা উঠতেছে। তারা আমারে বেশুমার গালাগালি করল এই প্রস্তাবের কারণে।

এই বাগানপ্রেমিক কাব্য করা লোকগুলার কথা শুনলে মনে হয়, চা শ্রমিকদের পূর্বপুরুষদের সকলেরই যেন চা বাগানেই জন্ম হইছিল!

যেন ওনারা অন্য কোথাও থিকা এই দেশে আসেন নাই যে এখন বেটার পেশার জন্যে চা বাগান একদম ছাড়া যাবে না!

ওনাদের নাকিকান্নার বয়ান, এইখানে চা শ্রমিকদের ৫ প্রজন্ম মাটিতে শুইয়া আছে! যেন যেখান থিকা তারা আসছিলেন সেখানকার মাটিতে তাদের ৫০ প্রজন্ম মাটিতে হুইয়া রয় নাই!

পেশার লড়াই সকলের আছে। দেশের এক জেলার লোক আরেক জেলায় পাড়ি দিতেছে পেটের দায়ে। কমিউনিটি বা ট্রাইব রক্ষা করতে গিয়া তাদেরকে দাস বানাইয়া রাখার ওকালতি কীভাবে করে বাম আন্দোলনকারীরা আমি বুঝতেই পারি না! সো স্যাড।

আরো দুঃখ এই যে, দাসেদের দিনমজুরি সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা হইলেই বামরেডরা সকলে সন্তুষ্ট!

৪.
এক এলাকার লোক আরেক এলাকায় গিয়া তাদের পেশা বাইছা কি নেয় না? অনেকেই শহরে, যেইখানে মজুরি বেশি, আইসা অবস্থার পরিবর্তন করছেন, চা শ্রমিকদের তা করতে দিতে আপনাদের আপত্তি কেন? পেশা কি একটাই নাকি!

আমি চা শ্রমিকদের বাগান থিকা ঠেইলা ভাগাইতে বলতেছি না। বলতেছি চা শ্রমিকরাও যাতে এই রকম বাইছা নিতে পারেন তার একটা অপশন তৈরি করার কথা।

এই অপশন চা শ্রমিকরা তৈরি করবেন না। করবে সরকার।

যার খুশি ৩০০ টাকা দিনমজুরিতে কাজ করুক। কিন্তু ৩০০ কোনো সমাধান না। বরং দাস ব্যবস্থা চলতে থাকাটা তাতে পোক্ত হয় আরো।

সারাদেশে লোকে যারা রিকশা চালায় তারা কি ক্ষেতখামারে মজুর হিসাবে না থাইকা বেটার অপশন হিসাবে এইটারে বাইছা নেয় নাই?

চা শ্রমিকদের চা শ্রমিকই থাকতে হবে কারণ তাদেরকে থাকতে জায়গা দেওয়া হইছে, এইটা যুক্তি হিসাবে ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়াশীল যুক্তি।

এই রকম তো দাসদেরও থাকতে দেওয়া হইত মালিকদের তাল্লুকে। এইটা কোনো থাকা না।

থাকা যখন না থাকার চাইতে বেদনাদায়ক হয় তখন যারা ভাগ্যবদলে আগ্রহী হয় না তারা আপনাদের মতো কারো নসিহত মানে বইলাই অগ্রসর হয় না।

৫.
৩০০ টাকা দেওয়ার লড়াইয়ে আপনারা যারা আছেন, তাদের অ্যাকটিভিজম চা বাগানের মালিকদেরকে শ্রমিক শোষণের সাসটেইনেবল অবস্থায় নিয়া যাবে। দাসদের কিঞ্চিৎ বেশি সুখী রাখা মহত্ত আরোপ করার মত কোনো বিষয় না।

চা রপ্তানীর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা লাভের যেই অবিবেচক দেশপ্রেম আপনাদের মধ্যে খলবল করে সেই জিনিসই দাসশ্রমিকদের চা বাগানে বংশ পরম্পরায় পুইত্তা রাখতে সাহায্য করে।

কীভাবে চা শ্রমিকেরা চাইলে বাগান ছাইড়া নিজের ইচ্ছার পেশা বাইছা নিতে পারে সে ব্যাপারে সরকার ও রাষ্ট্র নজর দেউক।

চা শ্রমিকদের দাসজীবনের অবসান ঘটুক!

২২/৮/২০২২

1 Comment

Add Yours →

Leave a Reply