‘লেখা’ জিনিসটা ছোটলোকের ক্রিয়েটিভিটি বা কালচারাল উপস্থিতি প্রকাশের মাধ্যম না। আমার অভিমত, সমাজে ছোটলোক যে জায়গা পায় না এই না পাওয়ার কারণও এইটা। লিখতে না পারা। বিমূর্তকরণের অক্ষমতা বা অল্প ক্ষমতা।
ছোটলোকের ভাষা কখনোই লিখিত রূপ-এ ঢুকতে পারে না। ঢুকতে গেলেই তা মিডল ক্লাস হইয়া যায়।
লিখিত রূপ-এ ঢুকতে না পারলে কখনোই সমাজের নিয়ন্ত্রক শ্রেণী হইতে পারবে না ছোটলোক। পরগাছাই থাকবে তারা। ছোটলোকের ভাষাকে ছোটলোকের ভাব, ভঙ্গি, সংস্কৃতি ও সমাজ সহকারেই উপস্থাপনের ভাষা হইতে হবে। কিন্তু ছোটলোক শিক্ষা গ্রহণ করলে আর ছোটলোক থাকতে পারে না। নব্য মিডল ক্লাসে পরিণত হয়। অথবা নব্য ধনীতে।
স্রেফ ভাষার কারণেই ছোটলোকেরা সমাজের নেতৃত্ব দিতে পারবে না।
মধ্যবিত্তের সমাজ ব্যবস্থাপনা ছোটলোকদের আটকাইতে ভাষার দেয়াল তুইলা রাখছে। এই দেয়াল পার হইতে গেলে প্রথমে ছোটলোকের ভাষাটি ও পরে ছোটলোক নিজে রূপান্তরিত হইয়া মধ্যবিত্তে পরিণত হয়।
এই সময়ের কিছু বিপ্লবী মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর ইনকিউবেটরে বা ডিম ফুঁটানোর যন্ত্রে ছোটলোকদের অনেক শব্দ ও ভঙ্গিমা লালিত-পালিত হইতে দেখতেছি। আপনারাও দেখতেছেন। ছোটলোকরাও দেখে।
এই প্রজেক্টরে ব্রিটিশ আমলের ইংরাজদের বাংলা ভাষা অনুশীলনের সঙ্গে মিলাইতে পারবেন। উদ্দেশ্যটা দখলের।
প্রজেক্টের ফল হিসাবে মধ্যবিত্তের ভাষা, চিন্তা ও বাছাইয়ের সঙ্গে পরিচিতি, সাবলীলতা ও মিশ্রণের কারণে ছোটলোকের মুখের ভাষাটি ধীরে আপন মহিমা ও অর্থ হারাইতে থাকবে।
অর্থাৎ যত দিন যাবে এনজিও ভঙ্গিমায় মধ্যবিত্ত হইয়া ওঠা ছাড়া ছোটলোকের পক্ষে মানুষ থাকাটি আর সম্ভব হবে না।
এবং মধ্যবিত্ত হওয়া মানে ছোটলোকের আর ছোটলোক না থাকা।
আর ছোটলোক যদি ছোটলোক না থাকতে চায় তবে ছোটলোক থাকবে কারা?
ইন্টেলেকচুয়ালদের মিশনারি প্রজেক্ট এগুলি। ছোটলোকের ভাষা দখলের চেষ্টাটি শুরু হয় তাদেরকে শিক্ষা, মিডল ক্লাসত্ব ও সম্ভ্রম দানের মাধ্যমে। এবং নিজেদেরকে তাদের ভাষার ব্যাপারে সহমর্মী ঘোষণার মাধ্যমে। এইটা পলিটিক্যাল। এইটা একই সঙ্গে ছোটলোক উৎখাতের মিশনও। অর্থাৎ ছোটলোকদের মধ্যবিত্ত বানাইয়া দেওয়ার মাধ্যমে ছোটলোকের ঝাড়ে বংশে নাশ।
এগুলি যে সবই সচেতন ভাবে ঘটে তা না।
টিকটক ইত্যাদি জায়গায় যে ছোটলোকি এক্সপ্রেশনগুলি এখন মিডল ক্লাস টিকটকাররা দখল করতেছে তা তারা ব্যঙ্গ বা কৌতুক হিসাবে বদলাইয়া দিয়া ছোটলোকরে আরো ভাষাশূন্য কইরা দিতেছে।
এ কারণে এই প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ যে মধ্যবিত্ত ছোটলোকের ভাষারে অবিকলভাবে নিবে কিনা, কেন নিবে, কতটা নিবে?
ততটা তো কেউ নিবেই না যতটা নিলে মধ্যবিত্ত সমাজে সে টিকতেই পারবে না। যদি টিকতেই পারত তবে মধ্যবিত্ত সমাজে ঢুকতে গিয়া ছোটলোকের নিজের ভাষা চেঞ্জ করতে হইত না।
একই সঙ্গে রাষ্ট্রের উন্নতি মানে হইল বছরে গরিব বা ছোটলোক কতটা কমতেছে। রাষ্ট্রের উন্নতি পূর্ণ হইলে তখন গরীব বা ছোটলোক থাকবে না, না থাকলে তার ভাষাও বাঁইচা থাকার কারণ নাই। বরং রাষ্ট্রের দুর্নীতি, অভাব, অনুৎপাদনশীলতা, গণতন্ত্রহীনতা ইত্যাদি ছোটলোকের সংস্কৃতির জন্যে সহায়ক উপাদান।
কাজেই যত দিন যাবে বা রাষ্ট্র যত উন্নত হইতে থাকবে মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ার আগ্রাসনে এক সময় ছোটলোক আর তার নিজের ভাষায় কথা বলবে না।
ছোটলোক যত উন্নতি করবে ততই চেষ্টা করবে মধ্যবিত্তের ভাষায় নিজেরে সাজাইয়া নিতে।
মধ্যবিত্ত হিসাবে আমি বরং মধ্যবিত্তের, এবং সেক্যুলারের, ভাষার পরিধি বাড়াইতে চাই।
বনেদি ও শুদ্ধ হইতে চাওয়া মুসলমানরা ইসলামি শব্দ, ভাষা ও ভঙ্গি এবং বনেদি হিন্দুরা হিন্দু শব্দ, ভাষা ও ভঙ্গি নির্ধারণ করেন ও সেই মত নিজেদের এক্সপ্রেস করেন। সেইটা তাদের জন্যে ঠিক আছে। সীমিত বা বাক্সবন্দি ভাষা ও শব্দের রাজনীতি আমার জন্যে নয়।
একই ভাবে ছোটলোকের বা এলিটের ভাব কিংবা বিদেশী ভাব-এ আমার আপত্তি নাই। কিন্তু নিজেরে আমি একান্তই এলিট বা ছোটলোকের ভাষায় কনভার্ট করতে আগ্রহী না। অর্থাৎ আমি এলিট বা ছোটলোক কোনোটাই হইতে রাজি না। আবার ছোটলোকের ভঙ্গি গ্রহণ কইরা মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী হইতেও না।
ছোটলোকের ভাষা বা উপস্থাপনের যে রীতি তাতো আমার না, যেমন এলিটের উপস্থাপনও আমার না। এই না থাকারে গণবিরোধী অবস্থান হিসাবে দেখানোটা মিথ্যাচার। কারণ গণ বলতে যা বোঝানো হয় শ্রেণী লোপাট কইরা সেই গণ হওয়া যায় না।
যারা ছোটলোকের কালচারাল এক্সপ্রেশনরে উর্ধ্বে তুলতে চান বা মধ্যবিত্তের জন্যে প্রযোজ্য ভাবেন তারা মূলত জিন্নাহগিরি করতেছেন।
ভাষার পরিধি অনেক বড়, একই শব্দ একেক শ্রেণী একেক অর্থ, ভাব বা ভঙ্গিতে ব্যবহার করে। তাই ছোটলোকের মুখের ভাষা আমার মুখের ভাষা হবে না।
অর্থাৎ কোনো শব্দই কোনো শ্রেণীর বাপের সম্পত্তি না। কিন্তু বাক্য, বাকরীতি বা ভঙ্গি শ্রেণী অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন। এক শ্রেণীর বাকরীতি অন্য শ্রেণী ব্যবহারের কালে তাতে ঝোঁক, বিকৃতি, ব্যঙ্গ, করুণা ইত্যাদির সংক্রমণ ঘটায়।
সচেতন মিডল ক্লাস হিসাবে সকল শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষাই আমার রাজনীতি। সকলকে মধ্যবিত্ত বানানোর কোনো ‘কম্যুনিস্ট প্রজেক্ট’ আমার নাই।
বরং আমার ‘কম্যুনিস্ট’ বা বাম বিরোধিতা আছে। মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির চাইতে সাংস্কৃতিক নিজস্বতা রক্ষা আমার কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাই সব মানুষরে মিডল ক্লাস বানানোর রাজনীতি আমি ঠেকাইতে চাই।
অর্থাৎ আমি শ্রেণী স্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাস করি। সকল শ্রেণীর বা ক্লাসের নিজ নিজ সাংস্কৃতিক মান বা অবস্থা নষ্ট না কইরা অর্থনৈতিক মুক্তিদানই রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দলগুলির লক্ষ্য হওয়া উচিত মনে করি আমি।
সেইটা কীভাবে সম্ভব তা কার্ল মার্কস বা বাম পলিটিশিয়ানদের পকেট থিকা বাইর হইবার নয়।
২৮/১/২০২৩