“পাখিটা বন্দী আছে দেহের খাঁচায়,
ও তার ভবের বেড়ী পায়ে জড়ানো
উড়তে গেলে পড়িয়া যায়…”
“পাখিটা বন্দী আছে দেহের খাঁচায়” মমতাজের গাওয়া মাসুদ পরিবারের তৈরি মাটির ময়না (২০০২) ফিল্মের দুর্বল একটা গান।
এতে লালনের গান ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’রে ব্যাখ্যা-সম্বৃদ্ধি দেওয়া হইছে।
লালন যেইখানে মাসুদ পরিবারের শতবর্ষেরও আগে (ডেথ ১৭/৯/১৮৯০) লিখতেছেন “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি” সেইখানে তারেক আইসা লিখতেছেন “পাখিটা বন্দী আছে দেহের খাঁচায়”।
লালনের ‘খাঁচা’ হেথায় ‘দেহের খাঁচা’ হইছে।
লালনের পাখিটির অচিনত্ব মনে হইল তারেকের পছন্দ না; তাই অচিন পাখি নিজেরে চিনাইতে ধরছে। যেন লালন পাখি চিনতে না পারার কারণেই লিখছিলেন “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি”।
পরিবর্তিত গানটা তারেকের সৃজনশীল কৃপাময়তায় এই রূপ নিতেছে: “দেহের খাঁচা”র ভিতর “মাটির ময়না” পাখি কেমনে আসে যায়।
এইটা তারেক লেখেন নাই। কিন্তু তাঁর গানের অভিভাবকতায় লালনের গান এই রূপও পরিগ্রহ করতে চায়।
২.
কেউ বলতে পারেন, মাসুদরা তো লালনের গান ব্যাখ্যা করতেছেন না। তাঁরা মাদ্রাসার বন্দি পোলাপাখিটির বন্দিত্ব নিয়া গান বানাইছেন।
যেমন:
কাঁচা বাঁশের ঘরটা ফেইলা
ময়না পাখি পাখা মেইলা,
তাদের সাথে মিশিতে চায়!
আমি একটু কাঠবুদ্ধিজীবী হই। ধরি এইখানে “কাঁচা বাঁশের ঘরটা” মানে মাদ্রাসা। ময়না পাখি মানে আনু। যাদের সাথে মিশিতে চায় তারা হইল মাদ্রাসায় যারা বন্দি নাই সেইসব বাচ্চা লুক। এই সরল গাণিতিক গান লইয়া আমারও রুচিসমস্যা নাই। স্নেহও নাই।
কিন্তু, গানটার শুরু এই রকম:
পাখিটা বন্দী আছে দেহের খাঁচায়,
ও তার ভবের বেড়ী পায়ে জড়ানো
উড়তে গেলে পড়িয়া যায়…
আমার বলবার বিষয় এই তিন লাইন।
শুরুতে মাদ্রাসা নাই। লালনের মেরামতি আছে। লালন কেন খাঁচারে “দেহের খাঁচা” বা জেলখানা বলতেছেন না আর ডেভেলপমেন্ট ঘরানার পরিচালক মাসুদ পরিবার কেন লালনরে সহজ করতে গিয়া “খাঁচা” যে দেহের খাঁচা তথা কারাগার তা বোঝাইতে ধরছেন তা ভাবিবার বিষয়। আসেন ভাবি।
৩.
এই গান লিখতে গিয়া লালনরে না টানলে এত কথা আইত না। খাঁচা যে দেহের খাঁচা বা জেলখানা তা লালন কদ্যপি বলেন নাই, তারেক বলতেছেন। লালনে খাঁচা বন্দিত্বের রূপক বা প্রতীক না। ওনার খাঁচা এমন যাতে পাখি আসতে ও যাইতে পারে। কিন্তু পাখিরে ধরা যায় না।
বন্দি করবে কইথন, পাখিরে তো ধরনই যায় না!
ধরতে পারলে লালন মনবেড়ী দিতেন। (লালনও বন্দি করতে চাইছিলেন। দেহেরে মনেতে। মনেরে বা আত্মারে দেহে না।) কিন্তু তিনি তো পাখিরে ধরতেই পারেন না। ফলে বন্দি করেনও না। বলেনও না যে পাখিটি বন্দি আছে মনবেড়ীতে।
পক্ষান্তরে (শুদ্ধ দীর্ঘ উচ্চারণে) তারেকের পাখির পায়ে ভবের বেড়ী পরানো আছে। কে পরাইলো? তারেক সফলকাম! খুব গৌতম বুদ্ধের দীর্ঘনিঃশ্বাস শোনা যাইতেছে। এই মায়াদেহ দুঃখময়। হেয় আছে বইলাই যত দুঃখ! ফলে পাখি যে আছে তাই তার পায়ে ভবের বেড়ী জড়ানো। ভবত্বই তার বেড়ীত্ব। পাখিটির নির্বাণ দরকার। নাইলে উড়তে গেলে ওনার ফল (fall) হবেই।
তারেকের (তারেকের বলতে তারেক ফ্যামিলিরও বোঝা যাইতে পারে) মস্তিষ্ক দিয়া ভাবতে গিয়া ভাবলাম, মানুষ দেহ কারাগারে বন্দি থাকে। এর অর্থ কী? যদি দেহ কারাগার তাইলে মুক্তিও তো দরকার।
সেই মুক্তি কী?
কার মুক্তি?
পাখির মুক্তি। অর্থাৎ দেহরূপ খাঁচা থিকা পাখিরূপ পাখির মুক্তি।
ভালো। তো লালনের পাখির পায়ে বুড্ডিজমের বেড়ী পরাইলেন তারেক। গৌতম বুদ্ধের নির্বাণ খাওয়াইতে ধরলেন লালনের গানরে। দেহপন্থীরা যেই বৌদ্ধ ভাব থিকা বাইর হইয়া গেছিলেন তারেক আবার তাদেরে সেই দেহের খাঁচায় ঢুকাইতে চাইতেছেন!
অদ্ভুত যে আধুনিক মানব সমাজ এই বৌদ্ধচিন্তার খরিদ্দার বটে। অথচ পূর্ববর্তী লালনরা এই চিন্তার সমালোচক। তারা দেহরে আত্মার অধীন বা নিম্ন ভাবেন না। দেহ হইতে আত্মারে আলাদা কইরা দেখেন না। লালনের দেহের খাঁচা কখনোই পাখিটির আত্মারে বন্দি কইরা রাখে না।
কেউ যদি বলেন, না, তারেক লালনের গানের তোয়াক্কা এইখানে করেন নাই; নিজে নিজেই নিজের গান রচনা করছেন তাইলে আমার বলার কিছু নাই। কিন্তু তারেক লালন ব্যাখ্যা করতে গিয়া বা লালনরে বাদ দিতে গিয়া যেই ভঙ্গিতে গৌতম বুদ্ধে আশ্রয় লন সেই অ্যামবুশ সমকালীন লেখক-শিল্পীদের প্রায় সকলেই করেন।
ফলে হেথায় তারেকরে খবরদারি করতে গিয়া তাদেরও কিঞ্চিৎ হুঁশিয়ার করন যাইতে পারে। হে নির্বাণলোভী লেখক-শিল্পীরা, দয়া কইরা দেহরে আত্মার ছোট ভাই বা ছোট বইন বানাইবেন না।
৪.
আনুর লগে মিলাইয়া মাদ্রাসা ভিত্তিক জীবন ব্যবস্থার বন্দিদশা নিয়া এই গান যদি আপনি শোনেন সেইলে ঠিক আছে।
কিন্তু তারেক কী কারণে সিনেমায় লালন ব্যাপার তথা দার্শনিকতা হ্যান্ডেল করতে গেলেন! কেনই বা আনুর বন্দিদশার লগে জগত আর জীবন ব্যাপাররে একসূত্রে গ্রথিত করতে চাইলেন!! আনুর মাদ্রাসা-বন্দিত্ব তো এমনিতেই (বিশেষত পশ্চিমা) সেন্টিমেন্ট উদ্রেককারী আছিল।
দেহবাদীদের আইটেম মাইরা এই দেশে প্রভূত গায়ক-গায়িকা ব্যবসা করতেছেন, সুর বিকৃত করতেছেন, ভাব নষ্ট করতেছেন, লঘু করতেছেন দেহদর্শনরে। মাসুদ ফ্যামিলিও এই গানে তা করছেন।
তারেকের এই ফিল্ম আমার দেখতে ইচ্ছা হয় নাই। এই গান আমার কখনোই ভালো লাগতো না। আমার সব প্রিয় লোকদেরই এই গান ভালো লাগে। আমি এখন কই যাই!
৫.
আপাতত তারেক মাসুদের ‘রানওয়ে’ দেখতে যাই। আইজকা ২রা অক্টোবর, শনিবার বিকাল ৩টায় গণগ্রন্থাগার শওকত ওসমান মিলনায়তনে তারেক মাসুদ নির্মিত ও ক্যাথরিন মাসুদ প্রযোজিত কাহিনীচিত্র ‘রানওয়ে’-এর উদ্বোধনী প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে।
আমি সেখানে যাইব।
৬.
১৯৯৪ সালের দিকে তারেক মাসুদের একটা ইন্টারভিউ আমি নিছিলাম। রাতে তার কলাবাগানের বাসায়ও থাকছিলাম। পরে সকালে যখন আমি চইলা আসব তারেক নানান বিনুনী গাইয়া রেকর্ড করা ক্যাসেটটা রাইখা দিছিলেন। প্রকাশ করতে দেন নাই।
কেন যে দেন নাই আশ্চর্য।
১৩/৯/২০১০ – ২/১০/২০১০
গানটি:
“পাখিটা বন্দী আছে দেহের খাঁচায়,
ও তার ভবের বেড়ী পায়ে জড়ানো,
উড়তে গেলে পড়িয়া যায়… ”
পাখিটা বন্দী আছে দেহের খাঁচায়,
দেখলে পরে জুড়ায় আঁখি
“নানান রঙের নানান পাখি,
আকাশেতে উইড়া বেড়ায়,
ও তার ভবের বেড়ী পায়ে জড়ানো,
উড়তে গেলে পড়িয়া যায়… ”
পাখিটা বন্দী আছে দেহের খাঁচায়,
কাঁচা বাঁশের ঘরটা ফেইলা
ময়না পাখি পাখা মেইলা,
তাদের সাথে মিশিতে চায়!
ও তার ভবের বেড়ী পায়ে জড়ানো,
উড়তে গেলে পড়িয়া যায়… ”
পাখিটা বন্দী আছে দেহের খাঁচায়,
মাটির তৈরি ময়না বলে,
‘তয়লে কেনে মনটা দিলে,
না দিলে জোর যদি ডানায়’,
ও তার ভবের বেড়ী পায়ে জড়ানো,
উড়তে গেলে পড়িয়া যায়…
পাখিটা বন্দী আছে দেহের খাঁচায়”