ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অ-বিপক্ষে আমার কমেন্ট

রাসেল পারভেজ ফেসবুকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দেন ২০ সেপ্টেম্বর ২০১০ তারিখে। আগ্রহীরা পারভেজের টাইম লাইনে সেপ্টেম্বর মাস দেখুন। তাঁর স্ট্যাটাস, আমার কমেন্ট ও তার কমেন্টের ভিত্তিতে এই নোট।

রাসেল পারভেজ

১৯৭৫ সালের অগাস্টের ৩০ তারিখে বাকশাল বিলুপ্ত করেছিলেন খন্দকার মুশতাক আহমেদ, তিনি বাকশালীয় এক দলীয় শাসনব্যবস্থাকে স্থগিত করে বহুদলীয় সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিকদের পুনর্বাসনের দায়টা জিয়াউর রহমান কিংবা খন্দকার মোশতাকের নয় বরং সে অপরাধ মজলুম জননেতা ভাসানীর, তার আজানুলম্বিত পাঞ্জাবির খুঁটো ধরে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিকেরা পুনর্বাসিত হয়।


ব্রাত্য রাইসু

বাহ, সকলেই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে! দক্ষিণপন্থী যে কোনো দলই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাপা সকলেরই রাজনীতি ধর্মভিত্তিক। আর আমাদের বামরা কি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করে না? তারা তো ধর্ম উৎসাদনের রাজনীতি করেই। তো ধর্ম খেদানোর রাজনীতিও তো ধর্মভিত্তিকই, না?

একান্তই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে আপনাদের অবস্থান কেন? কেবল বামরাই আর দক্ষিণপন্থী ধর্মভিত্তিকরাই রাজনীতি করবে?

রাজনীতিতে ধর্মের নাম নেওয়া যাবে না কেন? ধর্ম কি নাই?

স্ত্রী অসুস্থ, তাই রান্না করতে বসেছেন আবদুল হামিদ খান ভাসানী (ডিসেম্বর ১২, ১৮৮০-নভেম্বর ১৭, ১৯৭৬), পরনে অভিযুক্ত পাঞ্জাবি;ছবি: রশীদ তালুকদার
স্ত্রী অসুস্থ, তাই রান্না করতে বসেছেন আবদুল হামিদ খান ভাসানী (ডিসেম্বর ১২, ১৮৮০-নভেম্বর ১৭, ১৯৭৬), পরনে অভিযুক্ত পাঞ্জাবি;ছবি: রশীদ তালুকদার

 

রাসেল পারভেজ

রাইসু, প্রত্যেকের নিজস্ব ব্যাখ্যা আর অবস্থান আছে কেনো তার ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান করছে। নিঃশর্ত নেতানুগত্যভিত্তিক বামপন্থী রাজনীতির ভেতরেও একই ধরণের ধর্মীয় উপাদান বিদ্যমান এবং সেখানে নেতৃত্বের যেকোনো আদেশ নির্দেশ ও সমাজ বিশ্লেষণের পাল্টা অবস্থান নেওয়ার সুযোগ সীমিত- সেটা রাজনৈতিক চর্চার সমস্যা মূলতঃ।

রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার এবং সেটা কেনো ক্ষতিকারক এটা একটা মতাদর্শগত প্রশ্ন- তবে ১৯৭২ এ যখন সংবিধান প্রণয়ন করা হলো ঠিক সে সময়ে সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের প্রবিধান রাখা হয় নি , কিংবা ঘোষণা করা হয়েছে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চর্চা করা যাবে না কিন্তু প্রতিটি মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা অক্ষুন্ন থাকবে, সেটা প্রধানত স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সক্রিয় সশস্ত্র সহযোগিতাকারী রাজাকার ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের রাজনৈতিক আনতি বিবেচনা করেই করা হয়েছিলো। একই সাথে সংবিধানে অনেক ধরণের গলদ উপস্থিত থাকলেও বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি, যারা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবোধকে কবর দিয়ে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ কিংবা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্র নির্মানের পরিকল্পনা করেছিলো, সেখানে সকল ভাষাভাষির সমান অধিকার ও সমান অংশ গ্রহনের নিশ্চয়তা যেনো কোনো প্রকারে বিঘ্নিত না হয় সেটা নিশ্চিত করবার একটা বিষয় চলে এসেছিলো।

ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কুফল হলো এটা মানুষকে খুব দ্রুতই মানুষ পরিচয়বিচ্যুত করে খুব দ্রুতই একটি সম্প্রদায়গত পরিচয় প্রদান করে- এবং সেখানে একটি রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতিক্রিয়ায় ভিন্ন একটি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক মতাদর্শ বিকশিত হতে পারে-

আমি ব্যক্তিগত ভাবে ধর্মীয় রাজনীতির এই বিভেদাত্মক প্রবনতাকে ক্ষতিকর বিবেচনা করি এবং আমার ধারনা আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ে আমাদের ধর্মীয় উপাদানের তুলনায় অধর্মীয় উপাদানের প্রাচুর্য বেশী- ভাষা শেষ পর্যন্ত সেক্যুলার একটা যোগাযোগ মাধ্যম, সেটার ভিত্তিতে গঠিত রাষ্ট্রে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িকতার উপাদান যুক্ত না হওয়াই বাঞ্চনীয় এবং এর বিপরীত শক্তি হলো ধর্মীয় রাজনীতি-

অন্য অনেকে অনেকগুলো যুক্তি প্রদর্শন করতে পারে। সেসব যুক্তি নিয়েও আলোচনা চলতে পারে। কিন্তু এখানে মূল প্রশ্নটি হলো আমাদের এখানে সাংবিধানিক নিষেধ সত্ত্বেও কিভাবে ধর্মিভিত্তিক রাজনীতিবিদগন ধীরে ধীরে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হলেন- সে অপরাধ এককভাবে জিয়াউর রহমানের না কি সেখানে আমাদের ইসলামী সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা ও মজলুম জননেতার কোনো ভুমিকা ছিলো?

 

ব্রাত্য রাইসু

‎”ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার এবং সেটা কেনো ক্ষতিকারক এটা একটা মতাদর্শগত প্রশ্ন- তবে ১৯৭২ এ যখন সংবিধান প্রণয়ন করা হলো ঠিক সে সময়ে সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের প্রবিধান রাখা হয় নি” / Rasel Pervez

মতাদর্শগত উত্তর আপনি অবশ্য দিছেন, ফলে ‘সংবিধান অনুসারে জীবনযাপন’ ধরনের চিন্তার বাইরে যাই।

আপনি বলছেন,:

“ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কুফল হলো এটা মানুষকে খুব দ্রুতই মানুষ পরিচয়বিচ্যুত করে খুব দ্রুতই একটি সম্প্রদায়গত পরিচয় প্রদান করে- এবং সেখানে একটি রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতিক্রিয়ায় ভিন্ন একটি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক মতাদর্শ বিকশিত হতে পারে”

তাইলে সম্প্রদায় সম্প্রদায় থাকবে বটে কিন্তু রাজনীতি করতে পারবে না–এই তো? রাজনীতি করতে হইলে তারে মানুষ হইয়া উঠতে হবে। রাজনীতি করতে না চাইলে মানুষ না হইলেও চলবে। আপনারা তাদের রাষ্ট্রে থাকতে দিবেন। তো সেক্ষেত্রে ধর্ম হবে রাজনীতির আমানত।

তো এক সম্প্রদায় বেশি ক্ষমতা পাইলে অপর সম্প্রদায়রে নাশ কইরা ফেলবে। এমন যে হবে না বা হয় না তা না। কিন্তু এই চিন্তার প্রসার ঘটাইলে কালোদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হয়। আমেরিকার বিরুদ্ধে চিনাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হয়। এই একই পদ্ধতিতে ইসলামী ধর্মযোদ্ধাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ কইরা দিতে হয়। যেহেতু মার্কিনীরা (অর্থাৎ মানুষেরা) মুসলমান ধর্মযোদ্ধাদের আদৌ মারতেছেন না কাটতেছেন না তাই মুসলমানদের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ কইরা দিতে হবে, কারণ তারা চান্স পাইলে ”মানুষ”দের ফিনিশ কইরা ফেলবে। ”মানুষ”দের রাজনীতির নানান দৃষ্টান্ত থাকা সত্ত্বেও সম্প্রদায়গুলিরে মানুষ বানাইতে হবে তাইলে?

আপনার ভাষ্য থিকা মনে হয় মানুষ পরিচয়ের সঙ্গে মুসলমান বা হিন্দু পরিচয় সাংঘর্ষিক। যদি তাই হয়, তাইলে তো রাজনীতি করতে না দিলেও তা সাংঘর্ষিক। আর রাজনীতি করতে না দেওয়াটাই বা কী জিনিস। রাজনীতির সংবিধান সম্মত রূপরেই আপনার মতাদর্শ রাজনীতি বিবেচনা করতেছে। ভাগ্য ভালো যে রাজনীতি নিষিদ্ধ কইরা দিলেও যা চলে তারে রাজনীতিই বলে। নিষিদ্ধ ঘোষিত দলগুলা তখন নিষিদ্ধ রাজনীতি করে। তা সম্প্রদায়গত বৈরীতার চরম রূপ আত্মস্থ করার চেষ্টা করে।

২৯ অক্টোবর ২০১০

Flag Counter

3 Comments

Add Yours →

Leave a Reply