রবিবার ২৬ মার্চ দুপুর বেলায় সুরুচি ও সুসংস্কৃতির পত্রিকা প্রথম আলোরে নাটকের পারসোনালিটি মামুনুর রশীদ জানাইছেন তিনি হিরো আলমরে নিয়া বিরক্ত।
অনেক দিন ধইরাই বিরক্ত। তার কথায়, “এই হিরো আলম নিয়ে আমি অনেক দিনই বিরক্ত ছিলাম। বিরক্ত ছিলাম এই কারণেও, আমাদের দেশের মানুষের তো রুচির দুর্ভিক্ষ হয়ে গেছে।”
তিনি পিআলোকে বলেন:
“আমাদের মিডিয়া মুক্ত হওয়ার ফলে আমরা একটা রুচির দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়ে গেছি। সেখান থেকে হিরো আলমের মতো একটা লোকের উত্থান হয়েছে। যে উত্থান কুরুচি, কুশিক্ষা ও অপসংস্কৃতি দ্বারা উত্থান।”
তিনি আরো বলেন:
“আমাদের রাষ্ট্র তো কোনোভাবে রুচির উন্নয়নে কাজ করছে না। তাই এখন আমার আর রাজনীতির কাছে, রাষ্ট্রের কাছে, সংস্কৃতির কাছে, কোথাও আবেদন-নিবেদন নেই। আমার আবেদন, যে মানুষগুলো সামাজিক কাজের প্রতি দায়বদ্ধ, তাঁদের প্রতি।”
এইখানে মামুনুর রশীদ সততার পরিচয় দিছেন। রুচি যেহেতু আপেক্ষিক তাই তার কাছে হিরো আলম ধরনের লোকেদের রুচিকে কুরুচি ও অপসংস্কৃতি মনে হইতে পারে। সেইটা মামনুর রশিদ সাহেবরে বলতে দিতে হবে।
আবার কারো কাছে মনে হইতে পারে, সেইটা হিরো আলমের কাছেও মনে হইতে পারে, মামুনুর রশীদের যেই রুচি ওইটাই কুরুচি ও অপসংস্কৃতি। হিরো আলমরেও সেইটা বলতে দিতে হইবে।
বাক স্বাধীনতার চর্চা এইভাবেই হয়। এইটা স্বাস্থ্যকর।
কিন্তু এতে একটা কিন্তু আছে।
২.
কিন্তুটা হইল এই যে, দুই পক্ষের বলাবলির মান সমান নয়। একটা বলায় সমস্যা আছে।
সমস্যা এই জায়গায় যে একপক্ষ, মামুনুর রশীদদের পক্ষের এই বলাটা জাস্ট বলা নয়। এইটা নালিশ।
সরকার ও প্রশাসনের সাহায্য লইয়া অপর পক্ষের কথিত কুরুচি ও অপসংস্কৃতি বন্ধ করার নালিশ এইটা।
মামুনুর রশীদ সাহেবের “আমাদের মিডিয়া মুক্ত হওয়ার ফলে আমরা একটা রুচির দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়ে গেছি” নামক বাক স্বাধীনতাটি কীভাবে ফ্যাসিবাদ কায়েমের রাজনীতি সেইটা বরং বলি।
৩.
রশীদ সাহেব মিডিয়ার “মুক্তি”রে দোষারোপ করতে শুরু করলেন। মিডিয়ার সরকার তোষণ বা বাকহীনতা নিয়া তার কোনো আলাপ নাই। তিনি পইড়া আছেন হিরো আলমরে নিয়া!
হিরো আলমের নিউজ ছাপানোরেই তিনি মিডিয়ার মুক্তি ধইরা এরে হিরো আলমদের উত্থানের জন্যে দায়ী করতেছেন। এর মাধ্যমে এক ঢিলে দুই পাখি মারতেছেন তিনি।
প্রথম পাখিটি: এই দেশের মিডিয়া যে আসলে মুক্ত না সেই সত্যরে চাপা দিতেছেন। তিনি দেখাইতেছেন মিডিয়া মুক্ত।
দ্বিতীয় পাখিটি: হিরো আলমদের নিউজ ছাপানো বন্ধ করতে চাইতেছেন তিনি।
অর্থাৎ মিডিয়ার উপরে রাজনৈতিক যে সেন্সরশিপ তা তার জন্যে যথেষ্ট না, এখন দরকার সংস্কৃতি বিষয়ক সেন্সরশিপ। হাঃ হাঃ।
ভাবা যায়?
৪.
ফ্যাসিবাদ এইভাবেই কাজ করে। সাংস্কৃতিক খবরদারি ফ্যাসিবাদী নর্দমাগুলির একটা। মামুনুর রশীদ সাহেব সরসরি সেই খবরদারির আহ্বান জানাইলেন প্রথম আলোর ফ্যাসিবাদী সাংবাদিকতার মারফতে।
মামুনুর রশীদের মারফতে প্রথম আলো পত্রিকার কুরুচি ও অপসংস্কৃতি ঠেকানোর আহ্বান মূলত একটা হুমকি, এই হুমকি তথাকথিত ‘কুরুচি’ ও ‘অপসংস্কৃতি’র বিরুদ্ধে সরকার ও তাঁবেদার বাহিনী ব্যবহারের হুমকি।
দেখতে হবে কখন এই হুমকি গলা বড় করতে শুরু করল?
তা ঠিক এই সময়টায়ই বা কেন?
৫.
এতদিন সাংস্কৃতিক জগতের মোড়লিপনা কিছুটা অফ আছিল। তাদের গরম গরম আওয়াজ তেমন চোখে পড়ে নাই।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বগণের আওয়ামী রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত না হওয়ার নিরপেক্ষতাগিরির কারণে সরকার তাদেরকে সম্ভবত পাত্তা দিত কম।
কিন্তু সরকারের জন্যে সুখের কথা হইল, তারা এখন রাজনৈতিক ভাবে সাড়া দিতে শুরু করছেন!
আপনারা জানেন সম্প্রতি বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি লইয়া মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট একটা প্রতিবেদন দিছে। এই প্রতিবেদন ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’কে “বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ” করছে। তারা এই প্রতিবেদনের নিন্দা জানাইছেন।
এই নিন্দায় কিছু হউক না হউক সরকারের সুনজরে তারা আরো বেশি কইরা আসতে শুরু করছেন। এবং নিন্দাকারীদের সিংহভাগই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তারা কালচার করেন।
যতদূর বুঝি, রাজনৈতিক সমর্থন দানের কাজ জোরেশোরে শুরু করার কারণে সামনে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতের মালিকানা পাইতে যাইতেছে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’।
কালচারওয়ালারা এই সুযোগ হেলায় হারাইতে রাজি হবে কি?
হবে না।
মালিকানা হস্তগত হইলে কালচারাল অঙ্গনের বেশ কিছু পয়েন্টে নিজেদের পছন্দ মাফিক বদল ঘটাইতে পারবেন তারা। আওয়ামী সরকার তাদের অনুরোধগুলিরে কাজে পরিণত করতে রাজি হবে। তাতে রুচি ও সংস্কৃতি বিষয়ে নতুন নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে সরকার!
যেহেতু “সরকার এখন তাদের কথা শুনবে” ধরনের একটা মিষ্টি পরিবেশ তৈরি হইতে শুরু করছে তাই তারাও সরকারের কাছে তাদের সুন্দর সুন্দর দাবিগুলি তুইলা ধরতে শুরু করছেন।
বেশ একটা বিয়েবাড়ি ধরনের অবস্থা।
সুরুচি ও সুসংস্কৃতিরা হয়ত ভাবছেন তাদের কালচারাল দুর্দশার কারণ হিরো আলম। নাইলে তারা কত কিছু করতে পারতেন!
আমরাও সানন্দে দেখতে থাকি, তারা কী কী কিছু করতে পারেন?
২৭/৩/২০২৩