কবিসভায় ১৪ জুলাই, ২০০৪ তারিখে সঞ্চালিত
~
তাইলে ‘উপজাতি’ কইলে প্রবলেম; ‘আদিবাসী’ কইলে নাই? চাকমা, মুরং, খাসিয়া… সবাই মিলা আদিবাসী, আর আমরা একাই একশো বাঙালি!
উমংরে জিগাইলাম, উনি কইলেন ওনাদের অনেকে ‘উপজাতি’ না কইয়া ‘আদিবাসী’ কওনে বেশ খুশিই হন, কিন্তু অনেকে আবার নাকি হন না। তা তুন ও (উমং) একজন রাখাইন। উনি নিজেরে উপজাতি বা আদিবাসী বলতে রাজি না। উনি বলেন, আমি রাখাইন, আমারে রাখাইন বলবেন। আদিবাসী বলবেন কেন? উমং এইখানে অস্ট্রেলিয়ায় নাগরিক হইছেন। তার অস্ট্রেলিয়ান অনাদিবাসী বৌও আছেন। তিনি অভিযোগের সুরে যদিও কন নাই, কিন্তু জানাইলেন ঢাকায় তার বাঙালি বন্ধুরা তারে ‘মং’ বলে। ‘উ’ বাদ দেয় হেরা।
২.
মানুষেরে একটা পরিচয়ের মইধ্যে আইনা ফেলতে পারলে অত্যাচার করন যায় সহজে। এখন দেখা যাইতেছে অত্যাচারের বিরুদ্ধে কথা কইতে গেলেও যাগো উপরে অত্যাচার হয় তাগো সবাইরে এক পরিচয়ের আন্ডারে নিয়া আসতে চায় ‘সচেতন’ মানুষও। অত্যাচারী যে পরিচয় নির্ধারণ কইরা দেয় সেইটা বহাল রাখে তারা। বলে ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’।
দুনিয়ার মজদুর এক হয় না। কারণ কেউ-ই মজদুর পরিচয়ে বাঁচতে চায় না। মানুষের সাংস্কৃতিক পরিচয় (বাঙালি, সাঁওতাল, খুমী) তার রাজনৈতিক পরিচয়ের (মজদুর) বা ভূমিকেন্দ্রিক পরিচয়ের (আদিবাসী, পাহাড়ি, চউরা, সিলেটি ইত্যাদি) চেয়ে বড়। মজদুর নিজে তার আপন মানুষের পরিচয়ে পরিচিত হইতে চায়। ফলে বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ফেইল মারে।
৩.
বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর উপরে টাইট দেওনের রকমফের আছে হয়তো। চাকমা রাখাইন মগ ওঁরাও খাসিয়া মুন্ডা ওনারা সংখ্যালঘু। সকল সংখ্যালঘুর পক্ষে যদি কথা কইতে চাই (আমরা যারা সংখ্যাগুরুর বিবেকবৃন্দ আছি) একজন হিন্দুর উপরে অত্যাচার হইলে সেইটার বিরোধিতা আর একজন মুরং-এর উপরে অত্যাচার হইলে তার বিরোধিতা আর একজন বিহারীর উপরে অত্যাচার হইলে তার বিরোধিতা এই তিনটারে কি তিনভাবে বিরোধিতা করমু আমরা? বিরোধিতার ধরন যদি একই হয় তাইলে চাকমারে আদিবাসী বইলা অপমান করা কেন?
৪.
শান্তিচুক্তির পরে অধিবাসীরা আদিবাসীদের উপকার করায় বেশ মনোযোগী হইছেন। (কিছু ফান্ডও পাওয়া গেছে কি?) অত্যাচার সমাপনান্তে বই লেখনের সময় আইসা গেছে। অত্যাচার করতে পাইরা যত লজ্জা পাওয়া না গেছিল এহন বই যে এতদিনেও মহাশ্বেতার সমান লেখা হয় নাইক্কা সেই কারণে অধিকতর লজ্জায় সচেতন বুদ্ধিজীবী সমাজ আকুল! তাদের উপরে অত্যাচার নির্যাতনরে ‘নিপীড়নে’র মতো ‘কো ল্যাটেরাল ডেমেজ’ মার্কা শব্দ দিয়া অস্পষ্ট করা হইতেছে। অত্যাচারের বর্ণনা হয়তো ভবিষ্যত অত্যাচারের মাত্রা কমাইতে হেল্প করে। সেইজন্য বাঙালি লেখকদের এইসব লেখালেখির গুরুত্ব অপরিসীম (সদর্থে)।
কিন্তু তা করতে গিয়া শাসক বর্গের বুদ্ধিজীবীরা তাদের পরিচয়রে কেন বদলাইয়া দিমু? আমরা সংখ্যাগুরুরা তাদের কী নামে ডাকমু সেইটা নির্ভর করে তারা তাদেরকে কী নামে ডাকেন তার উপরে। মনে হয় না কোনো রাখাইন কোনো চাকমারে বলে, এই তুমি কিন্তু আদিবাসী। এইটা রাষ্ট্রের বাইন্ধা দেওয়া শব্দ। রাষ্ট্র এতদিন ‘উপজাতি’ বলছে। এহন স্থির করছে ‘আদিবাসী’ কইব। রাষ্ট্র আগায় গেছে গা!
৫.
বাংলাদেশে যাদের আদিবাসী বলা হয় তারা যদি বাংলাদেশের বাঙালিদের আদিবাসী নামে ডাকতে শুরু করেন (‘বাস্তব সত্যে’র পিন্ডি চটকাইয়া) তাইলে এই অসুখ কিঞ্চিৎ সারবে মনে করি। একই ভাবে পশ্চিমবঙ্গের সহি বাঙালিদের যদি অন্যেরা বাঙ্গাল (অন্তত পবাঙ্গাল) বলতে শুরু করেন তাইলে তাগো বাঙালিয়ানা কিছু কমলেও কমতে পারে। চেষ্টা কইরা দেখতে পারেন। যেমন আমরা বলতে পারি রবীন্দ্রনাথ পবাঙ্গাল, কমলকুমার পবাঙ্গাল, উৎপলকুমার বসু পবাঙ্গাল, শঙ্খ ঘোষ পবাঙ্গাল, দেবেশ রায় পবাঙ্গাল, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ আদিবাসী, মানস চৌধুরী আদিবাসী, লোপা আদিবাসী, জাহাঙ্গীর আদিবাসী, ব্রাত্য রাইসু আদিবাসী ইত্যাদি। এইসবে যদি কারো মনে হয় যে সত্যের অনেক খেলাপ হইয়া যাইতাছে… তাইলে তাদের বলতে হয়, ধরাধামে সত্য সবসময়েই বিনির্মাণ করা যায়। আর ইতিহাস বইলা যেই সত্যের ধামা আমরা ধইরা রাখছি তাও বিনির্মিত হইতে হইতেই ইতিহাস। এইখানে বিনির্মাণরে দেরিদার বিনির্মাণ না ধরলেও চলব। ধরলেও চলব।
ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া, ১৪.৭.২০০৪