“গত বৎসর মুসলমান শিক্ষাসম্মিলন উপলক্ষে খ্যাতনামা জমিদার শ্রীযুক্ত সৈয়দ নবাবআলি চৌধুরী মহাশয় বাংলা শিক্ষা সম্বন্ধে একটি উর্দু প্রবন্ধ পাঠ করেন, তাহারই ইংরাজি অনুবাদ সমালোচনার্থে আমাদের নিকট প্রেরিত হইয়াছে।”
“সৈয়দসাহেব বাংলা সাহিত্য হইতে মুসলমান-বিদ্বেষের যে উপকরণ সংগ্রহ করিয়াছেন সেগুলি আমরা অনাবশ্যক ও অসংগত জ্ঞান করি। বঙ্কিমবাবুর মতো লেখকের গ্রন্থে মুসলমান-বিদ্বেষের পরিচয় পাইলে দুঃখিত হইতে হয় কিন্তু সাহিত্য হইতে ব্যক্তিগত সংস্কার সম্পূর্ণ দূর করা অসম্ভব।”
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মুসলমান ছাত্রের বাংলা শিক্ষা
১.
শুরুতেই নামের বানান চেন্জ কইরা দিছেন রবিবাবু—লিখতেছেন ‘সৈয়দ নবাবআলি চৌধুরী’। হবে ‘সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী‘। যেভাবে আমরা লিখি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—’রবিন্দ্রনাথঠাকুর’ লিখি না।
‘সৈয়দসাহেব’ অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীর নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী (১৮৬৩ – ১৯২৯) ছিলেন অবিভক্ত বাংলার শিক্ষামন্ত্রী। শিক্ষা বিষয়ে তার দুইটা বই—এক, ভারনাকুলার এডুকেশন ইন বেঙ্গল (১৯০০), দুই, প্রাইমারি এডুকেশন ইন রুরাল এরিয়াস্ (১৯০৬)।
অর্থাৎ শিক্ষা বিষয়ে তার চিন্তা সচেতন চিন্তা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেবল শখের বশে বসান নাই তিনি, এইটা নবাবের রাজনৈতিক অ্যাকশন।
২.
দুঃখজনক যে বঙ্কিম ও অন্য মুসলমান-বিদ্বেষী সাহিত্যিকদের কু-রাজনৈতিক একটিভিটিজরে রবীন্দ্রনাথ স্রেফ ‘ব্যক্তিগত সংস্কার’ বইলা কোল দিতেছেন।
৩.
এখন রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যে ‘মুসলমান-বিদ্বেষ’ নিয়া যা বলছিলেন তা নিয়া ‘অসঙ্গত’ ভাবে দুইটা কথা কই।
এক, রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, এই ধরনের বিদ্বেষ সাহিত্য থিকা দূর করা “অসম্ভব”।
ঠিক আছে আছে অসম্ভব, মানলাম। কিন্তু তাই বইলা তা নিয়া কথা বলা যাবে না!
হাঃ হাঃ, যাবেই তো না! রবীন্দ্রনাথ এই নিয়া আপত্তিরে ‘অসঙ্গত’ মনে করছেন যে।
এখন আমার অবস্থান বলি। আমি রবীন্দ্রনাথের এই রকম অসঙ্গত মনে করারেই বরং অসঙ্গত মনে করি।
আমি মনে করি, বাংলা সাহিত্যে হিন্দু-বিদ্বেষ হইলে তার খবর করা যেমন সঙ্গত তেমনি মুসলমান-বিদ্বেষ ঘটলেও তার আপত্তি সঙ্গত ও রাজনৈতিক কর্ম।
তেমনটা না করার অর্থ ওইসব বিদ্বেষ-মূলক সাহিত্যের পক্ষে দাঁড়ানো। বা ওকালতি। উকিলের কি দোষ নাই কোনো?
দুই হইল, এই ভাবে ‘অসঙ্গত’ বইলা দিয়া হিন্দু ও মুসলমান-বিদ্বেষী সাহিত্যের বিপক্ষে অবস্থান না নেওয়াটা রবীন্দ্রনাথের কোনো ‘অ-রাজনৈতিক’ অবস্থান কিনা?
মানে জাস্ট কথার কথা কিনা?
না, তা না। যেহেতু রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা ও সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছেন, তার কথারে রাজনৈতিক না ভাবার কারণ নাই।
এইটা নিশ্চিতই রাজনৈতিক অবস্থান। এবং তার খারাপ রাজনৈতিক অবস্থান।
৪.
যারা বাংলা সাহিত্যে হিন্দুর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেন তাদের সাহিত্য হিন্দু-বিদ্বেষের কারণে সঙ্গত ভাবেই সমালোচিত হইতে পারে।
তেমনটাই, বাংলা সাহিত্যে মুসলমানের প্রতি বিদ্বেষ অনুসন্ধান কইরা তা নিয়া কাজ করছেন সৈয়দ নওয়াব আলী। তিনি অসঙ্গত কিছু করেন নাই।
রবীন্দ্রনাথের সমস্যা হইল ভদ্রলোক বিদ্বেষ করতে দিবেন, কিন্তু বিদ্বেষের সমালোচনা করতে দিবেন না।
চিন্তা করা যায়, কেমন মৌলবাদী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ!
আমি তো চিন্তাই করতে পারি না।
১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮