ফারজানা কবির রিতা ও তাঁর দুই সন্তানের আত্মহত্যা বিষয়ে (২০১০)
“ফারজানা কবির রিতা ও তাঁর দুই সন্তানের আত্মহত্যায় নিজেদের দায় স্বীকার করে নিয়েছেন সাংবাদিক শফিকুল কবির, তাঁর ছেলে রাশেদুল কবিরসহ পরিবারের সদস্যরা। পুলিশ দাবি করেছে, গতকাল সোমবার মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা বলেন, তাঁরা ফারজানার দুই সন্তানের দায়িত্ব নিলে দুঃখজনক এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।”
প্রথম আলো, ২৯ জুন ২০১০
“এদিকে রাশেদুল গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়ে দেন, তার সামনে রিতা যেদিন তার মাকে জুতা মারে সেদিনই তিনি রিতাকে তালাক দিয়েছিলেন।”
ভোরের কাগজ, ২৯ জুন ২০১০
১.
যেমন মানুষ তার সন্তানদের আত্মহত্যা করতে দেয় বা করতে উদ্বুদ্ধ করে বা শাশুরীকে জুতা মারতে পারেন তেমন মানুষের কাছ থিকা আত্মহত্যায় আগ্রহী না বা জুতা চান না তেমন প্রাণীরা যদি দূরে থাকতে চায় বা নিস্তার চায় তাতে কেন সমস্যা হবে? বা যদি একান্ত ভালো মানুষ পুত্রবধূরেও নিজের সংসারে না রাখতে চান কেউ সেইটা কেন আত্মহত্যার প্ররোচনা হবে? শফিকুল কবির তাঁর পুত্রবধূর কাছ থিকা দূরে থাকতে চাইবেন সে খুবই স্বাভাবিক নাগরিক চাহিদা। যদি রিতাকে নিজের সংসারে না রাখাটা তাঁর অপরাধ হয় তাইলে সে ধরনের অপরাধ তো রিতার বাবা-মার দিককার পরিবারের সদস্যদেরও আছে। এবং শফিকুল তাঁর ছেলের ছেলে-মেয়েদের কোন বিবেচনায় লালন-পালন করবেন যেখানে তাদের মা বর্তমান আছেন বা তাঁর ছেলে রাশেদুল আছেন? রিতার নোটের কারণে শফিকুলের হেনস্তা কাম্য পদ্ধতি হইতে পারে না। শফিকুল গং অপরাধী কিনা সেইটা আগে নিকাশ হওয়ার দরকার ছিল।
২.
ভাইবা দেখা দরকার, ফারজানা কবির রিতা নিজের আত্মহত্যার আগে তার দুই সন্তানরে আত্মহত্যায় রাজি করায়ছিলেন কিনা? যদি করাইয়া থাকেন তাইলে তিনি জোড়া খুনের আসামী। নিজে তিনি আত্মহত্যা কইরা তার থিকা পলাইয়া বাঁচতে পারেন। কিন্তু দায় থিকা বাঁচেন না।
সমাজ সংসার যারা চালনা করেন তাদের এই বিষয়ে দেখলাম নজর-টজর নাই। পুলিশেরও নাই। যদি তিনি সন্তানদের খুনের দায়ে দায়ী থাকেন তার বিচার আগে কইরা নেওয়া কর্তব্য।
ফলে জুরাইনের আত্মহত্যাকারী সন্তান আর তাদের মাকে এক কাতারে ফেলা ঠিক হবে না। নাবালক সন্তানদের আত্মহত্যার জন্য মা দায়ী কিনা, হাতে ধইরা আত্মহত্যা করাইছিলেন কিনা, বা তিনি আত্মহত্যার আগে তাদের হত্যা করছিলেন কিনা দেখা দরকার। মনে রাখা দরকার, এই কাণ্ডের আগেই ১১ জুন তারিখে বাবুগঞ্জে বাহেরচর গ্রামে মা রেনু বেগম তার তিন সন্তানরে খুন করার পর আত্মহত্যায় ব্যর্থ হন। (ধন্য ব্যর্থতা!) ফারজানা কবির রিতা তা দিয়া প্রভাবিত হইয়া থাকতে পারেন। নিজের সন্তানদের আত্মহত্যায় বাধা না দেওয়াটা কি হত্যাকাণ্ড নয়?
৩.
“রিতার আত্মহত্যার দায় তাঁর নয় বরং অন্যদের” এই সহানুভূতির মধ্যে আত্মহত্যারে সমাজসম্মত করার, এবং তেমন তেমন অবস্থায় আত্মহত্যা করা যাইতেই পারে এই বার্তা আমরা যারা এহনো আত্মহত্যা করি নাই বা আদৌ করতে চাই না তাদের দেওয়া হইতেছে। তো রিতার আত্মহত্যার দায় যারই হউক, তার সন্তানদের আত্মহত্যার দায় রিতার নিজের—ধরা খাওয়া শফিকুল কবির বা অন্যান্যদের নয়। কারণ নাবালক সন্তানদের আত্মহত্যায় উদ্বুদ্ধ করা এবং তার সকল উপাচার তৈরি রাখা ও আত্মহত্যা নিশ্চিত করার কাজটা নিজের আত্মহত্যার আগে রিতা কইরা গেছেন। এই ব্যাপার কি হত্যাকাণ্ড নয়?
প্রতিশোধস্পৃহার কারণে আত্মহত্যা বা সন্তান হত্যার বিষয়টা পুরানো। এমন শুনছি, নিজের সন্তানরে কোপাইয়া মাইরা প্রতিপক্ষের নামে মামলা দায়ের করে লোকে। (অবশ্য গ্রামে। রক্ষা। আমরা শহরবাসী সন্তানরা বাঁইচা গেছি।) তো আত্মহত্যার মাধ্যমে যাদেরে প্ররোচনাকারী বানাইয়া তোলা হয়, তারা তাদের কৃত অপরাধের বাইরে, ইচ্ছার বিরুদ্ধেই কেমনে কেমনে অপরাধী হইয়া যায়। এইভাবে আত্মহত্যাকারী নিজের অপরাধের মালাটা জীবিত “খারাপ” লোকদের গলায় আপসে পরাইয়া দেয়। যেহেতু মৃত লোক বইলা গেছে সুতরাং তাদের খারাপত্বের ব্যাপারে এমনকি পুলিশের, এমনকি পত্রিকাগুলার, এমনকি রাষ্ট্রেরও কোনো সন্দেহ থাকে না। কোন অপরাধে কীসের শাস্তি পায় “প্ররোচনাকারী”রা? এইভাবে প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ আত্মহত্যাকারীরে একটা সমাজ দিবে কিনা ভাবা দরকার। সমাজ প্রতিশোধকামীদের আত্মহত্যার দিকে ঠেইলা দিবে কিনা তাও ভাবা দরকার। “পুলিশ দাবি করেছে, গতকাল সোমবার মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা বলেন, তাঁরা ফারজানার দুই সন্তানের দায়িত্ব নিলে দুঃখজনক এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।” কিন্তু যারা দায়িত্ব নিতে আগ্রহী না তাদের উপর কেন আমরা দায় চাপাবো? একই পদ্ধতিতে রিতার সন্তানদের নানাবাড়ির লোকদের দায় নাই কেন? দায়িত্ব কেন নিতে হবে? সন্তানদের দায়িত্ব প্রথমত বাবা অথবা মায়ের। বাবা-মা জীবিত থাকলে দাদা-দাদি বা নানা-নানির নয়।
৪.
রিতা ও রাশেদুলের মৃত সন্তানদের প্রতি সমবেদনা রইল।
৩০/৬/২০১০