সলিমুল্লাহ খানের ব্রাত্য রাইসু বিচার, ২০১৮

ঈদসংখ্যা পরস্পরের ইন্টারভিউতে আমার প্রসঙ্গে সলিমুল্লাহ খান যা যা বলছেন সে অংশগুলি এখানে পেস্ট করা হলো। তার ইন্টারভিউ নিছেন ‘তরুণ লেখক’ কে এম রাকিব। পরস্পরের সম্পাদক কবি সোহেল হাসান গালিব।

১.
সলিমুল্লাহ খান:
আগেই বলেছি মাসুদ খান ভালো কবি। এমনকি সাজ্জাদ শরিফও খারাপ কবি নন। ব্রাত্য রাইসুও ভালো কবি। আমার কোনো বিরোধ নাই এঁদের, এই কবিদের সাথে। কিন্তু এঁরা যখন, ধরুন ব্রাত্য রাইসু যখন গদ্য লেখেন তখন মনে হয় যেন কোনো লেখাপড়া জানেন না। এখন বলে রাখি, লেখাপড়া জানা কবির জন্যে বাধ্যতামূলক নয়। তিনি যে লেখাপড়া জানেন না একথা তো সত্য, অস্বীকার করা যায় না। এটা ভালো কি মন্দ আমি জানি না। যখন তিনি বলেন কিনা ‘আমার লেখাপড়া জানার দরকারই নাই, আর লেখাপড়া জানলে কবিতা হয় না’, তখন আপনে কি করবেন, বলেন দেখি (হাসি)! অনেকে লেখাপড়া জানাটাকেই কবিতার শত্রু মনে করেন। এটা একধরনের কবিসুলভ অভিমান।

২.
সলিমুল্লাহ খান
ওই যে মার্কস সাহেব এক জায়গায় বলেছিলেন, অজ্ঞানতা কাউকে সাহায্য করে না, কথাটা ফেলনা নয়। জ্ঞান লাভ করে আপনি কাজে লাগাতে পারেন, নাও লাগাতে পারেন। কিন্তু অজ্ঞানতা আজ পর্যন্ত কাউকে তো কোনো সাহায্য করেনি, ভাই। তো, আমাদের ব্রাত্য রাইসু এ সত্যের একটা করুণ উদাহরণ। আমি তাঁকে খুব পছন্দ করি, রীতিমতো স্নেহই করি বলতে পারেন। আমার ‘আল্লাহর বাদশাহি’ নামক (অনুবাদ) কবিতার বইটা প্রকাশে তাঁর অনেক সাহায্য ছিল। সে কথা ভোলার মতো নয়। আমার অনুপস্থিতিতে বইটা উনিই (আর বলা প্রয়োজন সাজ্জাদ শরিফ) প্রকাশক যোগাড় করে বের করেছিলেন। আমি যাঁদের কাছে যেখানে যে ঋণ করেছি তা স্বীকার করতে হবেই। আর করলে দোষটাই-বা কি? কিন্তু দুঃখের কথা, তিনি নিজে লেখাপড়া করেন না। মনে হয় এই না করাটাকেই তিনি একটা ধর্মে উন্নীত করতে চান। আমি বলি, আপনি লেখাপড়া করতে ইচ্ছা না করে তো করবেন না। কিন্তু যাঁরা লেখাপড়া করতে চায়, তাঁদের দোষ দিচ্ছেন কেন?

৩.
সলিমুল্লাহ খান:
কবিতার ক্ষেত্রেও সমস্ত ইনোভেশন আমার ভালো লাগবে এমন কোনো কথা নাই। আমার এইখানে পছন্দ-অপছন্দ আছে। যেটা আমি বুঝতে পারি না সেইটা আমি ভালো বলব কেন? এখন কেউ যদি বলে আপনি এখানে ‘রাজার নতুন জামা’ পরে বেরিয়েছেন, আপনি তো কিছু জানেন না এইটাই প্রমাণিত হলো। তথাস্তু। আমি যেটা জানি সেটার কথাই বলছি। যেটা জানি সেটা বলি, কবিতার মধ্যে আমি বোদলেয়ার পড়েছি, তাঁর উপর দুটা সেমিনারও করেছি। ফরাসিতেও কিছু কিছু পড়েছি। গদ্যকবিতাগুলোও পড়েছি। আমার পৃথিবীতে প্রিয় কবিদের মধ্যে একজন এই বোদলেয়ার। অন্য কবিদেরও আমি পছন্দ করি। সুতরাং আমার কবিতার রুচি সম্পর্কে আমার কিছুটা ধারণা আছে। যাদের কবিতার কথা বলছি, যেমন ব্রাত্য রাইসুর মধ্যে একটা ক্ষমতা ছিল। সেটা হচ্ছে তাঁর চমকপ্রদ কথা বলার ক্ষমতা, তিনি বলতে পারতেন চমৎকার। কিন্তু ওই যে চমক দেওয়ার মোহ… মৃদুল দাশগুপ্ত তাঁর সম্পর্কে মনে হয় সঠিক কথাই বলেছেন: এই চমক দিয়ে সারাজীবন চলা যায় না। উনি কিন্তু গত বিশ বছরে একইঞ্চিও বড় হননি। বনসাই বলে একটা কথা আছে না? রাইসু হচ্ছেন বনসাই। তাঁর নাম রাইসু বদলে কেউ যদি বনসাই দেন তাহলে চমৎকার একটা কাজ হয়। হি ডিড নট সিমপ্লি গ্রো।

কে এম রাকিব:
বাংলা কবিতার মধ্যে আকাশে কালিদাসের লগে মেগ দেখতেছি একটা…

সলিমুল্লাহ খান:
ওইটাই তো। ভালো কবিতার বই। এরপরে কিন্তু আর কিছু লিখতে পারে নাই। হালিকের দিন ওটাও আমি পড়েছি। আমাকে তাঁর বইয়ের রিভিউ লিখতে তিনি বলেছিলেন। দুঃখের মধ্যে, আমি রিভিউ লেখার কিছু খুঁজে পাই নাই। কারণ তিনি প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করেন। আমি যে সমস্ত শব্দ বা বাগ্বিধি পছন্দ করি না, সে যে সমস্ত ‘চ’ শব্দ ব্যবহার করেন, আমি ওটা রুচিবহির্ভূত বলেই মনে করি। আশা করি আমাকে ভুল বুঝবেন না, আমি রবীন্দ্রনাথ নই, আমি মোটেও রুচিবাগীশ নই। কিন্তু এখন একজন লোক, কোনো আধুনিক কবি যদি তাঁর আম্মাজানকেই বিয়ে করতে চান, তিনি করতে পারেন, আমি এটা অনুমোদন করব না।

কে এম রাকিব:
এইরকম মাকে বিয়ে করা বা ইনসেস্ট—এরকম ব্যাপার কি আসলে তাঁর কবিতায় আছে?

সলিমুল্লাহ খান:
ওঁর কবিতা সেরকমই। যখন বাংলা ভাষায় কেউ চ-শব্দ ব্যবহার করেন, তখন বুঝতে হবে তিনি তাই করছেন। অর্থাৎ তাঁর পাপটা হচ্ছে প্রকৃতির বিরুদ্ধে নয়, সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। সংস্কৃতির একটা আয়না আছে। প্রকৃতি থেকে সংস্কৃতিতে প্রমোশন পাওয়া যায়। তিনি সেটার বিরোধিতা করছেন।

কে এম রাকিব:
এভাবেও তো কেউ বলতে পারে যে, এই যে শব্দের ভালোমন্দ, মার্জিত-অমার্জিত হওয়ার ব্যাপার—এগুলাও আসলে একধরনের শ্রেণিরুচির ব্যাপার, ডমিন্যান্ট বা ডমিনেটেড শ্রেণির মূল্যবোধগত ব্যাপার। অ্যাবসলিউট কিছু না।

সলিমুল্লাহ খান:
আমার বক্তব্যটা আমি বলছি। আমি ওটাকে মনে করি সংস্কৃতির বিরোধিতা। আমি যেটিকে সংস্কৃতি মনে করি, এখন আমার এটাকে আপনারা সমালোচনা করেন, আমার তো আপত্তি নাই। আমি আমার কথাই বলছি। আমি অন্যের কথার দায়িত্ব নেব না। রাইসুর কবিতাতে যে সমস্ত ‘চ’ জাতীয় শব্দ আছে, আরও অনেক কবিরই আছে, আরও উদাহরণ আছে, রাইসু অপেক্ষাকৃত ভালো কবি বলেই তাঁর নামে আলোচনাটা হচ্ছে। এগুলোকে আমি আমার রুচির যে [ছোটমতো] গণ্ডি, তার বহির্ভূতই মনে করি। অর্থাৎ আমার যে কাব্যের আসর, তাতে তার স্থান হবে না। তাঁর আসরে তো আমি জায়গা খুঁজতেছি না, তাই না?

৪.
সলিমুল্লাহ খান:
কিন্তু আমি যাঁকে বড় লেখক মনে করি তার উদাহরণ একমাত্র আহমদ ছফা। রবীন্দ্রনাথের পরে সর্বশেষ বড় লেখক আহমদ ছফা। শুধু এই স্বাধীন বাংলায় না, ওই ভারতাধীন বাংলায় না, সব বাংলাতেই—গদ্যে, পদ্যে, গল্পে, কবিতায়, চিন্তায় সবচেয়ে বড় লেখক আহমদ ছফা। কবি হিসেবেও ছফা অনন্য। গালিবদের আমার পছন্দ হয় না কি জন্য জানেন? তাঁরা আহমদ ছফার কবিত্ব বোঝেন না। তাঁরা তো ইম্ম্যাচিউর, [ওঁরা পাকেন নাই]। আহমদ ছফার কবিতা বুঝতে যে বয়সের দরকার তা ওঁদের হয় নাই। গালিবের হয়নি, রাইসুর হয়নি, সাজ্জাদের হয়নি, গোমেজের হয়নি। তাহলে এদের অপ্রাপ্তবয়স্ক ছাড়া আমি আর কি বলতে পারি? লিটমাস টেস্ট বলে একটা বাক্য আছে… আপনি এইটার পরীক্ষা দিবেন তো রঙটা বদলায় কিনা দেখতে পারবেন…।
আহমদ ছফার কবিতা যাদের ভালো লাগে না তাঁদের ভালো কবি বলার কোনো কারণ আমি দেখি না।

লিংক: সলিমুল্লাহ খানের সাথে একান্ত আলাপ – পরস্পর

Leave a Reply