জসীম উদ্‌দীন আবিষ্কৃত ‘কবিতার তিন প্রকার প্রকাশধারা’—নিলাম না!

আমার প্রিয় কবি ফরহাদ মজহার একটা লেখা লিখছেন rtnn.net-এর সংস্কৃতি পাতায়। লেখার নাম—কবিতার তিন প্রকার ‘প্রকাশধারা’ : জসীম উদ্‌দীনের কাব্যবিচার পদ্ধতি। লেখাতে আমাদের সাহিত্যিক বড় ভাই জসীম উদ্‌দীনের কাব্যবিচারের তিনটা প্রকাশধারা নিয়া আলাপ করছেন ফরহাদ ভাই। জ. যেইভাবে ধারাগুলা দেখছেন তার থিকা সংক্ষেপ উদ্ধৃতি দিলাম আমি। পরে ফরহাদ ভাইয়ের একটা ছোট উদ্ধৃতি। পরে আমার মতামত লেখলাম। লেখার শেষে জসীম উদ্‌দীনের এই প্রকাশধারারে আমি রিজেক্ট করছি। তার জন্যে সরিও বলছি। / ব্রারা 

ধারা ১: ‘‘একদল বলিতেছেন, আমরা পাকিস্তান অর্জন করিয়াছি আমাদের তহজিব তমদ্দুনকে রূপায়িত করিবার জন্য। পাকিস্তান যেমন নতুন দেশ আমাদের সাহিত্যও হইবে তেমনি নতুন, পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সাহিত্য হইতে সম্পূর্ণ আলাদা। বাংলা সাহিত্যের উপমা, অলঙ্কার ও প্রকাশভঙ্গিতে যেখানে যেখানে পৌত্তলিকতার গন্ধ আছে সে সকল সম্পূর্ণ বর্জন করিয়া আমরা আরবি, ফারসী ও উর্দু সাহিত্য হইতে উপমা অলঙ্কার আহরণ করিয়া প্রকৃত ইসলামী সাহিত্য গঠন করিব।” / জসিম উদ্‌দীন

ধারা ২: “এই নতুন সাহিত্য গড়িতে তাঁহারা ইউরোপ, আমেরিকান কবিদের মতাদর্শ এবং প্রকাশভঙ্গিমা অবলম্বন করিয়া এক ধরনের কবিতা রচনা করিতেছে, ইহারা কেহ কেহ পশ্চিমবঙ্গের অতি আধুনিক কবিদের ভাবশিষ্য। প্রেম-ভালবাসা, স্বদেশানুভূতি, সবকিছুর উপর তাঁহারা Satire-এর বাণ নিক্ষেপ করেন। তাঁহাদের কেহ কেহ বলে, বর্তমানে সাহিত্য তৈরি হইবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিতদের গ্রন্থশালায়, জনসাধারণের মধ্যে নয়।’’ / জসিম উদ্‌দীন

ধারা ৩: “তাঁহারা গ্রামে যাইয়া গ্রামবাসীদের সঙ্গে মিশিয়াই শুধু তাহাদের অন্তর জানিতে চাহেন না; যুগ যুগান্তর হইতে আমাদের গ্রামদেশে যে অপূর্ব লোকসাহিত্য রচিত হইয়া আসিতেছে তাহার ভিতরে গ্রামবাসীদের মনের কথা খুঁজিয়া বেড়ান। নিজেদের লেখায় সেই লোকসাহিত্যের কোন কোন কথা ভরিয়া দিয়া দেশের পূর্বসূরিদের সঙ্গে তাঁহাদের সাহিত্যের যোগ সংযোগ করেন।” / জসিম উদ্‌দীন

“এই ধারা শুধু অরাজনৈতিক নয়, গণবিরোধীও বটে। এখানেই জসীম উদ্‌দীনের আপত্তি এবং আমি তাঁর সঙ্গে একশ ভাগ একমত। যাঁরা এই ধারা চর্চা করেন শ্রেণীর দিক থেকে তাঁরা জনসাধারণের কাছাকাছির মানুষ নন। এই শ্রেণীচরিত্রের দিকটি ছাড়াও জসীম উদ্‌দীনের আরো আপত্তির কারণ হলো, ‘‘প্রচলিত বাংলা ছন্দ যাহা ভারতচন্দ্র হইতে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বহু মনীষীর দানে শত বাহুবিস্তার করিয়াছে ইহা বর্জন করিয়া তাঁহারা দুর্বোধ্য প্রকাশে নিজেদের কাব্যসম্ভার সৃষ্টি করেন।” / ফরহাদ মজহার [ধারা ২ সম্পর্কে]

 

লন্ডনে জসিম উদ্‌দীন, ১৯৫১

এক.
জসীম উদ্‌দীনের সঙ্গে বা জসীম উদ্‌দীনে একমত ফরহাদ ভাইয়ের সঙ্গে একমত হওয়া গেল না।

প্রথমত জসীমকৃত এই তিন ধারারে গুরুত্ব দিতে চাই না। কেননা তিন ধারা সম্পর্কে যেভাবে জসীম উদ্‌দীন বলতেছেন তা তাঁর অল্প চিন্তার ছায়ায় তৈরি।

কবিতারে কবির প্রত্যয় বা ‘আমি কবিতায় কী করমু’ দিয়া বিচার করাটা জনসাধারণের কাজ হইতে পারে। কবির বা ক্রিটিকের কাজ নয়। কবি বা ক্রিটিক দেখবেন কবিতায় কী আছে। কবি কী করতে চাইয়া কী কইরা ফেলাইলেন সে আলোচনা সাহিত্যে মুখরোচক উপাদানের অধিক কিছু না। ফলে প্রথম ধারার কবিদের মধ্যে আকছার অমুসলমান শব্দ আবিষ্কার করা যাবে। এবং স্যাটায়ারও মিলবে। দ্বিতীয় ধারার কবিদের গুরুস্থানীয় বুদ্ধদেব বসুর কবিতা ‘চিল্কায় সকাল’-এ তাকানো যাক:

কী ভালো আমার লাগলো আজ এই সকালবেলায়
কেমন করে বলি?
কী নির্মল নীল এই আকাশ, কী অসহ্য সুন্দর,
যেন গুণীর কণ্ঠের অবাধ উন্মুক্ত তান
দিগন্ত থেকে দিগন্তে;

কী ভালো আমার লাগলো এই আকাশের দিকে তাকিয়ে;
চারদিক সবুজ পাহাড়ে আঁকাবাঁকা, কুয়াশায় ধোঁয়াটে,
মাঝখানে চিল্কা উঠছে ঝিলকিয়ে।

তুমি কাছে এলে, একটু বসলে, তারপর গেলে ওদিকে,
স্টেশনে গাড়ি এসে দাড়িয়েঁছে, তা-ই দেখতে।
গাড়ি চ’লে গেল!- কী ভালো তোমাকে বাসি,
কেমন করে বলি?

আকাশে সূর্যের বন্যা, তাকানো যায়না।
গোরুগুলো একমনে ঘাস ছিঁড়ছে, কী শান্ত!
-তুমি কি কখনো ভেবেছিলে এই হ্রদের ধারে এসে আমরা পাবো
যা এতদিন পাইনি?

রূপোলি জল শুয়ে-শুয়ে স্বপ্ন দেখছে; সমস্ত আকাশ
নীলের স্রোতে ঝরে পড়ছে তার বুকের উপর
সূর্যের চুম্বনে।-এখানে জ্ব’লে উঠবে অপরূপ ইন্দ্রধণু
তোমার আর আমার রক্তের সমুদ্রকে ঘিরে
কখনো কি ভেবেছিলে?

কাল চিল্কায় নৌকোয় যেতে-যেতে আমরা দেখেছিলাম
দুটো প্রজাপতি কতদূর থেকে উড়ে আসছে
জলের উপর দিয়ে।- কী দুঃসাহস! তুমি হেসেছিলে আর আমার
কী ভালো লেগেছিল।

তোমার সেই উজ্জ্বল অপরূপ মুখ। দ্যাখো, দ্যাখো,
কেমন নীল এই আকাশ-আর তোমার চোখে
কাঁপছে কত আকাশ, কত মৃত্যু, কত নতুন জন্ম
কেমন করে বলি।

(চিল্কায় সকাল; বুদ্ধদেব বসু)

এইখানে স্যাটায়ার নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিতদের গ্রন্থশালা নাই। আরো বহু কবিতায়ই স্যাটায়ার নাই। (স্যাটায়ার থাকলেই কী! স্যাটায়ার জিনিসটা যেন জনসাধারণের বাইরে বইসা আছে!) বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিতদের গ্রন্থশালায় নয় তাদের জীবনযাত্রা থিকাই তাদের কবিতা উইঠা আসছে। কিছু কবিতা যদি পণ্ডিতদের গ্রন্থশালায় তৈরি হয় তাতেই বা কী সমস্যা। সবকিছুই যদি কবিতার উপাদান তবে পণ্ডিতদের গ্রন্থশালা কেন নয়?

দুই.
জকৃত তৃতীয় ধারার কবিরা উন্নয়নমার্গী কবি। গ্রামজীবনরে শহরবাসীর কাছে তুইলা আইনা হৃদয়ের গ্রামরে বাঁচাইয়া রাখতে চেষ্টিত ছিলেন তারা। যেন গ্রাম একটা শাপলা ফুল—ওনারা বেচতে আসছেন শহরের বাজারে! আহারে!

এইটা উপরের দুই `ধারা’র চাইতে দুর্বল, অদরকারী ও গ্রামসমাজে আক্রমণকারী `ধারা’। এই `ধারা’র কবিরা গ্রামের কবি বা গায়কদের কৃত্য মাইরা দিয়া তাদের সাহিত্যিক সম্ভাবনায় ভজকট পাকাইয়া গেছেন। এই `ধারা’র কবিদের উৎপাদন দিয়াই বর্তমানে টেলিভিশনের মাধ্যমে অদ্ভুত এক গ্রামসমাজের দেখা মেলে। যে গ্রাম এইসব কবিদের মারফতে পাওয়া স্ক্রিপ্টরাইটারদের তৈরি গ্রাম।

গ্রামের মনরে আপনি সেইখানে পাইবেন না। মনে হইতে থাকবে শহরবাসী দেখবে তাই গ্রামবাসীরা পর্দার ভিতরে বাছুরের মত ছুটতে লাগছে!

তিন.
কবিতা কে কোন ভাষায় লিখবে বা কবিতার উপাদান কী হবে তা কবিতার ক্ষেত্রে গৌণ ব্যাপার। তা দিয়া প্রকাশধারা নিবেদন করাটা কাজের কথা নয়। জসিম উদ্‌দীনের এই `প্রকাশধারা’রে আমি রিজেক্ট করলাম। সরি।

১৮/৩/২০১৩

Leave a Reply