ফরহাদ মজহার এর ‘বড় কবি’ বিচারের সমস্যা

ফরহাদ মজহার তার ২০১৯ সালে দেওয়া একটা ইন্টারভিউতে অতনু সিংহের সঙ্গে নিচের কথাগুলি বলছেন। ইন্টারভিউটা পুনঃপ্রকাশিত হইছে তার প্রতিপক্ষ পত্রিকায়।

ইন্টারভিউর কেবল “বড় কবি” বিষয়ক অংশ লইয়া আমার আলাপ।

ফরহাদ মজহার বলতেছেন:

“মনে রাখতে হবে জালাল উদ্দীন খাঁ আল মাহমুদের থেকেও বড় কবি, সেক্ষেত্রে শিক্ষিত বই পড়ুয়া মধ্যবিত্ত মানুষের শ্রেণীর আঁতে ঘা লাগবে। মনে রাখবেন জালাল উদ্দিন খাঁয়ের কাছে শামসুর রাহমান কিছুই না। আল মাহমুদও কিছুই না। এমনকি রাধারমণের কাছে কিংবা বিজয় সরকারের কাছে… । লালনের নাম নিলাম না। কিন্তু বাংলা কবিতার ইতিহাস থেকে এদের বাদ দেওয়া হয় আভিজাত্য ও শ্রেণীগত কারণে।”

“উৎপল তো ওই অর্থে কমিউনিকেটিভ নয়। উৎপল আমার আদর্শ নন। এমনকি আমরা যে ছড়া পড়ি, সেই ছড়াও তো আসলে কমিউনিকেটিভ নয়। তার সুর, তাল, ছন্দ আছে। কিন্তু কমিউনিকেটিভ তো ওই অর্থে না।”

(লিংক: আগামী একশো বছর নজরে রেখে কবিতা লিখি: ফরহাদ মজহার)


ফরহাদ ভাইয়ের কথা শুনলাম। এখন আমার কথা বলি।

আমার কথা হইল, ফরহাদ ভাই যাই বলুক, যতই বলুক তবু পাণ্ডিত্য, পড়ালেখা, তত্ত্ব বা দর্শনের কারণে কোনো কবি বড় হন না।

ফরহাদ মজহারেরও বড় কবি হইতে হইলে তত্ত্ব, দর্শন বা রাজনৈতিক চিন্তা তার কবিতায় আছে কি নাই তা দিয়া কাজ হবে না—কবিতার মধ্য দিয়াই তাকে বড় কবি হইতে হবে।

তিনি বড় কবিই, তবে তার দর্শন বা রাজনৈতিক চিন্তার কারণে তিনি বড় কবি হন না।

আজকের সেক্সি দর্শন আর গভীর রাজনীতি দুইদিন পরে মহাশ্মশানে পরিণত হইলে কবিতা বইলা কিছু অবশিষ্ট থাকবে না আর এক যুগ পরেই, একশো বছর অনেক পরের ব্যাপার।

আর তিনি যেই ‘কম্যুনিকেশন’ থিওরি দিয়া উৎপলের কবিতারে ছড়া বলতে চান তা তার দুর্বল কৌশলের সীমাবদ্ধতা।

ছড়া যাদেরকে কম্যুনিকেট করে তা কোনো ব্যাখ্যা দিয়া করে না, অব্যাখ্যাও কম্যুনিকেশন।

কবিতার ভাবসম্প্রসারণ বা সরলপনা একটা ধরন মাত্র। অতি বোধগম্য ছড়াও আছে।

অর্থাৎ তার কবিতা কম্যুনিকেট করলো কি করলো না দিয়াও ফরহাদ মজহার বড় কবি হবেন না।

কত লোকে কবিতা বুঝতে পারল এইটা একটা ভেইগ বিচার। ফরহাদ মজহারের পাঠক আর সমসাময়িক লেখক-কবিদের প্রায় সকলেই তার কবিতা কম্যুনিকেট করার পরেও লক্ষ লক্ষ লোকে তার সরল কবিতাগুলিও বুঝতে পারতে নাই পারে।

এর প্রমাণ হিসাবে ফরহাদ ভাই নিজেই জালাল উদ্দীন খাঁ’র কবিতার ব্যাখ্যা কইরা কইরা কম্যুনিকেট করাইতে চান। বোধকরি লালন কম্যুনিকেশন যজ্ঞও একই রকম ব্যাপার।

২.

ফরহাদ মজহারের কবি বা কবিতা বিচারের সমস্যা হইল তিনি পাণ্ডিত্য দিয়া বা মস্তিষ্ক বা বুদ্ধির সরদারি দিয়াই কবিতার ও কবিদের বড়ত্ব বিচার করেন।

মনে রাখতে হবে কোনো কবি দর্শনের বিষয়-আশয় আনেন বইলাই কবিতার দুনিয়ায় তিনি বড় হন না।

জালাল উদ্দিন খাঁ, রাধারমণ বা বিজয় সরকার সাহেবরা দর্শনের ক্ষেত্রে নতুন কিছু আনতে পারলেন কিনা তা দিয়া তাদের কবিতা বিচার হবে না। “আভিজাত্য ও শ্রেণীগত কারণে” তাদেরকে গ্রহণ না করার কারণেই তারা বড় কবি এমনটাও নিশ্চয়ই বলতেছেন না কবি ফরহাদ মজহার।

তাইলে যেইখানে মিডল ক্লাসের সব ধরনের বিচারই “আভিজাত্য ও শ্রেণীগত কারণে” সেইখানে তিনি কেন লালন, জালাল উদ্দীন খাঁ, রাধারমণ বা বিজয় সরকারকে অভিজাতদের দ্বারা গ্রহণ করাইতে চাইতেছেন?

তারা তো ফরহাদ মজহারের হিসাবে বড় কবিই। এবং এই বড় কবিরা তো অবলীলায় মিডল ক্লাস কবিদের বাদ দিয়াই নিজেদের আর্ট-কালচার করেন।

কই, লালন, জালাল উদ্দিন খাঁ, রাধারমণ বা বিজয় সরকাররা তো ছোট কবি হিসাবেও শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ বা ফরহাদ মজহার এর নাম নেন না!

তাইলে কেন মিডল ক্লাস আর্টিস্টদেরকেই বড় কবিদের খুঁইজা আনতে হবে অনভিজাত ও ছোটলোকদের মধ্য থিকা?

মানে এই যে তিনি মিডল ক্লাসকেই বড় কবি বিচারের মূল দায়িত্ব দিতে চান এই জায়গায়ই মিডল ক্লাস কবিতা বিচারই মিডল ক্লাসের জন্যে যথোপযুক্ত হয়।

ছোটলোকের কবিতা ও গানের মধ্য দিয়া বিবিধ দার্শনিক আবিষ্কার ও পুনরাবিষ্কারকে গুরুত্ব না দেওয়াটা মিডল ক্লাসের জন্যে নিতান্ত ছহি বিষয়।

তারা তো হেগেল, কান্টরেও গুরুত্ব না দিয়া তাদের কবিতা লিখতেছেন।

এখন দেশী হেগেলদের ধার্য্য কইরা কবিতা লিখতে হবে কেন?

ভারি চিন্তা নিয়া যেমন কবিতা হইতে পারে, চিন্তাহীন কবিতাও থাকতে পারে।

কবিতার কাজ নয়, দর্শনের ভারবাহী হওয়া।

লালন, জালাল উদ্দিন খাঁ, রাধারমণ বা বিজয় সরকারদের দর্শন নিয়া আলাপের ক্ষেত্রে তাদের কবিতার সঙ্গে শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদদের কবিতার দর্শন-নিরপেক্ষতার তুলনাটা একটু হাস্যকরই।

আরো পড়ুন: প্রমিত, অপ্রমিত, ফাইজলামি ও ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে কুতর্ক উইথ ফরহাদ মজহার, সাল ২০১৪ টু ২০১৮

ফরহাদ ভাইয়ের প্রস্তাবকৃত উপরের দার্শনিক-কবিরা হয়তো দর্শন চর্চা কইরা গেছেন ভালো গদ্য না জানা থাকার কারণে কবিতা দিয়াই। তদুপরি তাদের দার্শনিক কবিতাবলির তুলনা করতে হবে পশ্চিমের দার্শনিকদের মধ্যে যারা একই বিষয় নিয়া আলাপ সারছেন তাদের সঙ্গেই।

কবিদের মধ্যে যারা দার্শনিক কবিতা লেখেন নাই তাদের সঙ্গে অবশ্যই নয়।

কবিদের সঙ্গে তুলনা করতে গেলে আগে পাণ্ডিত্যপূর্ণ কবিতা কেন না-পণ্ডিতি কবিতার তুলনায় শ্রেষ্ঠ সেই বিচার সাইরা লইতে হবে।

ফরহাদ মজহার কি তা সারছেন?

মনে হয় না।

১/৮/২০২১

Leave a Reply