রবীন্দ্র অভিশাপ, পশ্চিমবাংলা ও কবীর সুমন

ইন্ডিয়ান, বিশেষত পশ্চিমবাংলার, কবি সাহিত্যিক শিল্পীরা আমাদের দেশে আইসা তাদের প্রতিভা প্রদর্শন করবেন এতে দোষ নাই।

এবং তারা এখানেও তাদের দেশের শ্রোতা-পাঠকদের রুচিমাফিক থাকবেন, তাদের সাংস্কৃতিক প্রভাবই প্রচার করবেন, সেইটাই স্বাভাবিক।

পশ্চিমবাংলাকে অভিশপ্ত রবীন্দ্রবাংলা বলাই যায়। সেস্থলে বসবাসকারী কবীর সুমন রবিবাবুরে বর্জন করবেন সে ঘোষণা কখনো দেন নাই। কাজেই যারা কবীর সুমন শুনবেন, তারা রবীন্দ্রনাথের ধারাবাহিকতাই তার কাছ থিকা শুনবেন, তাতে কেন সমস্যা?

আমাদের যা দরকার তা হইল বাংলাদেশের শ্রোতারা কেন এই মিষ্টি মিষ্টি রবীন্দ্র ভাবধারারে এখনো সমালোচনা করার জায়গায় পৌঁছাইতে পারলেন না তা ভাবতে শুরু করা।

কেননা আমাদের এখানে রবীন্দ্র অভিশাপ ততটা নাই। আমরা গান ও পাঠে একটি মাত্র রবীন্দ্র বস্তার ভার বহন করি না।

এখানে বৈচিত্র্যের ‌উপস্থিতি আছে। যে কারণে কবীর সুমনে বাংলাদেশী শ্রোতাদের অবনত ভাব নেহায়েত গানের প্রতি ভালোবাসা মাত্র নয়, পশ্চিমবাংলা প্রীতির এই সর্বভারতীয় উচ্ছ্বাস কিছুটা মফস্বলিয়ানা আর কিছুটা দারিদ্র্যের প্রকাশ বটেই।

যারা বলেন তার গানের প্রতি ভালোবাসা থিকাই তাদের উচ্ছ্বাস, তারা তার গানের মধ্যকার ক্লিশে আর না-রাজনীতিটা কেন ধরতে পারেন না সেই দারিদ্র্যের কথা আর নাইবা বললাম।

আমি মনে করি কবীর সুমন শক্তিশালী গায়ক, তবে তার ধারা, বিষয় বা গন্তব্য আমার আগ্রহের জায়গা নয়।

এবং এইটা তার নিজের কোনো সমস্যাও না, বরং পশ্চিমবাংলাই এই সমস্যার মূল।

পশ্চিমবাংলা যেই সাংস্কৃতিক ব্যাকরণ দিয়া তার নাগরিকদের লক্ষ্য, বিষয় ও অহঙ্কাররে গণ্ডিবদ্ধ বা বন্দি কইরা রাখতেছে তার থিকা মুক্তি তার বন্দি নাগরিকদের অন্বেষণের জিনিস হইতে পারে। কিন্তু কেন তারা বা কবীর সুমন তা বুঝতে পারেন না সেই দোষ তাদেরকে দেওয়া যায় না।

আমরা যেহেতু তা সহজেই উপলব্ধি করতে পারি তাই আমাদের পিছাইয়া থাকা শ্রোতা-দর্শকদের লজ্জার জায়গাটা তাদেরকে ধরাইয়া দেওয়া আমাদের অবশ্য কর্তব্য।

২.
আমি কখনোই কবীর সুমন বা সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গান শুনি নাই।

শুনি নাই বলতে রাস্তাঘাটে, বাসে বা কারো বাসাবাড়িতে বাধ্যতামূলক শোনা যেইটা হয় তার কথা বাদ দিয়া নিজের আগ্রহে শোনার কথা বলতেছি।

তোমাকে চাই নামে একটা গান তখন অনেক জনপ্রিয় হইছিল ওনার। আমার সমকালীন কবি-লেখক বন্ধু ও অল্প বড় যে ভাইরা শাহবাগে, বিশ্বসাহিত্যে বা আজিজ টাজিজে আড্ডা মারতাম একসঙ্গে তাদের অনেকেই এই গানের খুব ভক্ত আছিল। আমার খুব হাসি পাইত। ফালতু লাগত এই গান।

গান জিনিসটা বন্ধু ও প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যে রুচির পার্থক্য বুঝতে খুব কাজের জিনিস। কোন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কয়দিন তার হিসাবের বেলায় গানের পছন্দ-অপছন্দ থার্মোমিটারের কাজ করে।

তো যারা এই তোমাকে চাই পছন্দ করতেন তাদের সঙ্গে আমি আর সাহিত্য বা কালচার লইয়া বিশেষ আলাপ-সালাপে যাইতাম না।

এই ধরনের ধরতে পারা বা বুঝতে পারাগুলির কারণে আমার জীবনে শিল্প-সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তিগত অপচয়ের পরিমাণ কম। খারাপ বই আমি কম পড়ছি, যেহেতু বইই পড়ছি কম, আর কম বোঝা বন্ধুদের উচ্ছ্বাসে তাল দেই নাই বিধায় আলাপও করতে হইছে কম।

অতীতের দিকে তাকাইলে তাই আক্ষেপ করার মত কিছু তেমন পাই না। আর্ট-কালচার নিয়া আমার মন যা চাইছে আমার বুদ্ধিবৃত্তিও পরবর্তী কালে দেখতে পাইছে যে আমি ঠিকঠাকই ছিলাম। সেইটা এমনকি পলিটিক্সের বেলায়ও।

সো নাইস।

১৬/১০/২০২২

Leave a Reply