আমার ধারণা, প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক সেইভাবে আহমদ ছফার গুরু ছিলেন না।
যেইভাবে তার বই ‘যদ্যপি আমার গুরু’ রাজ্জাকরে ছফার গুরুতে পরিণত করছে।
আমি এই বইয়ের নামকরণ নিয়া সেই তখনই আপত্তি করছি, ১৯৯৮/৯৯ এর দিকে, যখন বাইর হয়।
ছফা ভাইয়ের কাছে আমার প্রশ্ন ছিল—রাজ্জাক সাহেব কোন আপত্তিকর কাজ করলেন যে আপনার তাকে “যদ্যপি” বলতে হইল?
“যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ীবাড়ি যায়, তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়” এইটার সঙ্গে রাজ্জাকের শুঁড়ীবাড়ি যাওয়ার ঘটনা কোনটা?
ছফা ভাই এই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেন নাই। উত্তর না থাকলে বা দিতে না চাইলে ছফা ভাই শিস বাজাইতেন, একবার।
কাজেই বইটার নাম ছফা রাখছিলেন ঐতিহাসিক ওই ছত্রের সঙ্গে মিলাইয়া ভালোবাসার তীব্রতা দেখাইতে।
২.
রাজ্জাক সাহেবরে যে ছফা গুরু বলতেন সেইটা কেবল বিনয় কইরা না।
বরং ছফার জন্যে রাজ্জাক সাহেবের মতো লোকরে গুরু বলাটা তখন অনেকগুলি সামাজিক সমস্যা কাটানোর সহজ রাস্তা ছিল।
বৈরী সমাজে টিকা থাকার জন্যে এইটার দরকার আছে।
ছফার সঙ্গে তো উপরের মহলের লোকরা প্রকাশ্যে খুব মিশতে রাজি ছিলেন না। তার অ্যাকসেস ছিল না শেষের দিকে, অত।
আনিসুজ্জামান বা সনজীদা খাতুন তথা রবীন্দ্রনাথরা মিশতে দিতেন না নিজেদের সঙ্গে, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীররাও। মতিউর রহমানরা ওনার লেখা ছাপতেন না। পত্রিকা ইত্যাদির কালচারাল অনুষ্ঠানগুলিতে বয়কট করতেন ছফারে।
আরো কারা কারা ছফার সঙ্গে মিশতেন না বা মিশতে দিতেন না সেই গবেষণা করা যাইতে পারে।
৩.
কিন্তু রাজ্জাক সাহেব ছফারে স্পেস দিতেন। ঘনিষ্ঠ ভাবেই মিশতেন।
তবে কামাল হোসেন টাইপের বড়লোক শিষ্যরা যখন আসতো তখন আবার ছফারে ডাকতেন না তিনি।
রাজ্জাকের বড়লোক শিষ্যরা যে ছফারে পছন্দ করত না এইটারে রাজ্জাক সাব সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন নাই। কেন কে জানে।
ছফা যখন রাজ্জাকের নামটা ব্যবহার করলেন গুরু হিসাবে তখন যেইটা ঘটল, বড়লোক বুদ্ধিজীবীদের যা আছে বা যেই গুরু আছে তারও থাকল সেই গুরু বা সেই ধন।
একই আড্ডায় অ্যাকসেস না থাকলেও গুরু তো একই!
এখন সবাই জানে, ছফার গুরু রাজ্জাক, রাজ্জাকের শিষ্য ছফা!
বাকিরা আর নাই।
কামাল হোসেন তথা কনজারভেটিভ বড়লোকগুলির এই ক্ষতিটা করছেন ছফা।
বড়লোকদের ক্লাবের সবচাইতে উঁচু অবস্থানের ও শ্রদ্ধা পাওয়া লোকটারে মিডল ক্লাসের গুরু বানাইয়া তাদের আভিজাত্যরে কালিমালিপ্ত কইরা দিছেন তিনি।
৪.
ছফা কী করলেন, তিনি রাজ্জাকরে গুরু ঘোষণা করলেন। অভিজাত বুদ্ধিজীবীদের সমাজরে অভিভাবকহীন কইরা দিলেন এর মধ্য দিয়া।
বড়লোক বুদ্ধিজীবীদের থিকা রাজ্জাকরে আলাদা কইরা দখল করলেন তার বইয়ের মাধ্যমে। ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইয়ের মাধ্যমে।
এই বই নিয়া বড়লোক বুদ্ধিজীবীগুলি কিছু লিখছে কি? দেখছেন?
এইটা তৎকালীন অভিজাত বুদ্ধিজীবী সোসাইটির বিরুদ্ধে ছফার প্রায় জাতীয় পর্যায়ের একটা বিজয়।
এখন দেখেন, মিডল ক্লাস ও প্রায় গরিব ছেমড়া-ছেমড়িদের খুব প্রিয় হইছে এই বই। তারা ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইখানি কোলে কইরা রাখে!
যেই রাজ্জাক কিনা সাধারণ পোশাক পইরা ‘সিম্পল লিভিং হাই থিংকিং’ হিসাবে চলতে পছন্দ করতেন বিত্তশালীদের সঙ্গে, তাদেরকে সরাইয়া ছফা তারে বানাইছেন ধ্যারধেরা মিডল ক্লাসের এক আইকনিক গুরুতে। হাঃ হাঃ।
ফলে পরে কোনো বড়লোক আর ওইভাবে রাজ্জাকরে গুরুও বলতে যায় না, নিজেদের লোক হিসাবেও দেখাইতে যায় কিনা সন্দেহ।
৫.
মিডল ক্লাস শিষ্যের বড়লোক ও গ্ল্যামারাস গুরুর প্রতি ভালোবাসা ও দখলের বাসনার সামাজিক কারণ অত সূক্ষ্ম হইতে হয় না।
তা প্রকটই থাকে।
রাজ্জাক বিষয়ে বই লেখার ঘটনাটারে সেইভাবে দেখা যাইতে পারে।
রাজ্জাকরে ছফার গুরু ধরতে হয় কালচারাল ফাইটের উপাদান হিসাবে। সত্যিকারের গুরু অর্থে নয়।
এইটাই হয়তো বইয়ের নামের মধ্যে ‘যদ্যপি’ ব্যবহারের অন্তর্নিহিত অর্থ।
আমি যতদূর বুঝি, রাজ্জাক সাহেবের ছদ্মবেশী বড়লোকগিরিরে শিক্ষা দেওয়ার একটা ইচ্ছা ছফার থাকারই কথা ছিল।
না থাকলেও শিক্ষাটা তিনি দিছেন।
ফকিরের ঘরে যেই ধন আছে, অভিজাত বুদ্ধিজীবীরা সেই ধন দিয়া কী করবে?
২১/৭/২০২১