১.
এখনও দেখি প্রভূত বাংলা গল্প উপন্যাস রাইটাররা বলেন, গল্প উপন্যাসে লেখকের না ঢুইকা নাকি উপায় নাই। এ না হইলে নাকি কোনো সৃজনই হয় না!
২.
লেখকের চিন্তা, লিখনপ্রক্রিয়া ও উদ্ভাবনের চাইতে অভিজ্ঞতারে গুরুত্ব বেশি না দিলে গল্প বা উপন্যাস রাইটারদের এমন বক্তব্য দেওয়ার কথা না। এই ধরনের বক্তব্যে ধরা হয় লেখকের লেখা আসলে কোনো লেখা না–অভিজ্ঞতার বয়ান; অভিজ্ঞতাই আসল মাল–লেখা তার বিচ্যুত বা অতিশায়িত রূপ মাত্র! লেখার কাজ হইল অভিজ্ঞতারে রূপ দেওয়া।
যদি লেখা=অভিজ্ঞতা হয় তাইলে ওনাদের এই হিসাব শাস্ত্রসম্মত। ঠিকই আছে। যদি না হয় নাই।
৩.
ওনারা বলতেছেন, লেখক যাই লেখেন না কেন, যদি নিজেরে না ঢুকাইলেন তাইলে গল্প নাহি হবে। লেখক নিজেই হাতে কলমে কীবোর্ডে লেখেন, চিন্তা করেন, অভিজ্ঞতার বয়ান দেন, চরিত্রের উপযোগী উপস্থাপন ঠিকঠাক করেন–তা করতে গিয়া বিবিধ অভিজ্ঞতার হেল্প নেন। এগুলা কিন্তু “লেখকের না ঢুইকা উপায় নাই”-এর মধ্যে পড়ে না! লেখকের জীবন-অভিজ্ঞতারে ঢুকাইতে হবে। লেখক যে চিন্তা করেন সে চিন্তা যখন ঢুকান তা কিন্তু লেখকের ঢোকা না। লেখক যে পরস্পর বিরোধী চরিত্রের সম্মিলন ঘটান, নতুন ধরনের বয়ান হাজির করেন, অভিজ্ঞতায় নাই তেমন জিনিস যে লিখতে লিখতে জারিত হয় তাও যখন লেখেন লেখক সেও কিন্তু লেখকের ঢোকা নয়। ঢোকা হইল তখনই যখন লেখক কখনো স্ব-ইচ্ছায়, কখনো ইচ্ছানিরপেক্ষভাবে গল্পে হাজির থাকেন। এইটা যে কী জিনিস আমি বুঝতে পারি না। ব্যক্তির আমিত্বের দাবিই বুঝি তার অস্তিত্বের প্রমাণ?
লেখকের জীবনের ঘটনাই হচ্ছেন লেখক–এমন দাবি করা যায় না। তেমনি লেখকের কোনো মূল্যায়ন মাত্রই নয় লেখকের জীবন। এগুলা লেখকের জীবনের অংশ। এমনকি যা লেখা হয় তাও লেখকের জীবনের অংশ। তো লেখকের জীবনের অংশ হিসাবে কোনো অভিজ্ঞতা দিয়া লেখক যখন এমনকি আত্মজীবনীও লিখবেন তা লেখকের জীবনের অংশ মাত্র। লেখকের আত্মজীবনীও লেখকের জীবন নন–মানে লেখক নন। সো লেখায় লেখক ঢুইকা থাকেন বলতে গেলে বলতে হয় লেখকের বুঝি সারমর্ম হয়। মানে জীবনের সংক্ষিপ্তসার বুঝি লেখায় প্রতিফলিত হয়। বা সারমর্ম আকারে লেখক বিরাজ করেন লেখায়।
যদি লেখকের সারমর্ম না হয় তাইলে কোনো লেখকের পক্ষেই তার লেখায় ঢুকা সম্ভব না। লেখক তার যেই অভিজ্ঞতা নামধেয় জিনিসরেই লেখায় ঢুকান না কেন তা লেখার মইধ্যে আত্তীকৃত হইয়া যায়, তারে লেখকের নিজের জীবনের অংশ হিসাবে দেখার অবস্থা থাকে না। এমনকি তেমন অভিজ্ঞতা লেখার জন্য অনিবার্যও কিছু না। লেখক কেবল লেখতেই পারেন। উনি, মানে সম্মানিত লেখক, যদি মনে করেন ওনার লেখায় উনি ঢুকছেন তথাপি তা তার লেখার অনেক ভাবে দেখানো সম্ভব অবস্থার মধ্যে একটা বিষয় মাত্র, ওইটা উনি না। অভিজ্ঞতা বইলা সমাজের অভিভাবক দাবিকারী এই লেখকেরা যেই মাল চালাইতে চান ওগুলা প্রায়শই তাদের অপ্রাপ্তি, বেদনা আর কম দিয়া বেশি পাওনের আকাঙ্ক্ষা। এবং আপনার আশা-আকাঙ্ক্ষা, বেদনা, হতাশা ইত্যাদিও আপনি নন, সুতরাং গল্পে ঢুকনের আশা বাদ দিয়া গল্প লেখনের চেষ্টা করেন–যথেষ্ট।
১২/৯/২০১১ – ১২/১২/২০১১