দেশ টিভিতে ক্রিয়ার কথ্য রূপ বিষয়ে ফারজানা রূপা ‘একটি টিভি সাক্ষাৎকার’ নিছিলেন কয়েকজনের, ২০১০-এর ফেব্রুয়ারিতে। এতে ফারজানা ভাষা প্রশ্নে শামসুজ্জামান খান ও কবীর চোধুরী ও আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন। ওই সাক্ষাৎকারখানি ‘(: ভাষা-ফ্যাসিবাদীদের ঠেকাও! – Bhasha-Fashibadider Thekao! : )’ নামে একটা এফবি পেইজে আপ করা হইছিল। বন্ধু জয়দেব সেইখানে ইন্টারভিউটা দেইখা একটা লেখা লিখছিল ফেসবুকে। কিন্তু সে তো মারা গেল গিয়া! তো এইখানে সেই টিভি সাক্ষাৎকার, জয়দেবের লেখা ও আমার উত্তর সন্নিবেশিত হইল। জয়দেব যেহেতু আর নাই তার ফেসবুক একলা একলাই থাকবে তাই লেখাটা কুতর্কের দোকানেও খানিক রাইখা দিলাম; জয়দেবের বিনা অনুমতিতেই। কবি জয়দেব বসুর সঙ্গে তেমন বচসা ঘইটা উঠতে পারল না তার তাড়াহুড়ার কারণে। জয়দেবের প্রতি ভালোবাসা।
‘একটি টিভি সাক্ষাৎকার’>>
জয়দেব বসুর লেখা >
কী লিখি, কীভাবে লিখি … (ভাষা ব্যবহার বিষয়ক একটি টিভি সাক্ষাৎকার দেখে)
সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ! বাংলাদেশ!এখানে কে, কীভাবে বাংলা লিখবে তা নিয়েও আইন প্রণয়নের উদ্যোগ দেখা যায়!!! অথচ, আয়কর-বিক্রয়করের আইন অতীব আলুলায়িত। দেশ জুড়ে রেলপথ পাতা হয় না কেন? প্রকাশ্য উত্তর: পানি-র দেশ। আসলে ওজুহাত, মূল উত্তর হলো, বেসিক ইন্ডাস্ট্রি নাই। কেন নাই? উত্তর: ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদ। ‘দাতা’ দেশগুলি অবশ্য সাম্রাজ্যবাদী নহে। উহারা নিম-ফুলের মধু।
সইত্য সেলুকাস, কী বিচি-ত্র এই দেশ!!!!
কবির চৌধুরি কহেন, ‘সিরিয়াস’ কোনো লেখার ক্ষেত্রে ‘ইঙ্গ-বঙ্গ’ ভাষার প্রয়োগ চলবে না।
ভালো কথা। তবে কীনা, কথাটা হচ্ছিলো বাংলার লোকায়ত প্রয়োগ নিয়ে, ‘ইঙ্গ-বঙ্গ’ নিয়ে না। পশ্চিমবঙ্গে ‘ইঙ্গ-বঙ্গ’ প্রয়োগ নিয়ে বেশ কিছু বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। বাংলা-অকাদেমির উদ্যোগে আয়োজিত একটি কবিতা কর্মশালায় সুনীল গাঙুলি একবার এই নিয়ে তাঁর আপত্তি জানিয়েও পরে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। উপরন্তু, কবির চৌধুরি-র কথা অনুযায়ী, কবিতা কোনো সিরিয়াস লেখা না।
সইত্য সেলুকাছ…….
অন্যদিকে ব্রাত্য রাইসু, যিনি বলেন: ভাষা-কে তিনি যেমনে খুশি তেমনে ব্যবহার করবেন, কারণ এটা তাঁর ‘রাইট’।
ঠিক কথা। কিন্তু, তাঁর নিজের পাঠ-ও দেখুন: ‘আপনি কমলকুমার মজুমদার-কে বলতে পারবেন না যে, আপনি ছোটো-ছোট বাক্যে লিখুন।’
কমলকুমার নিয়ে বাঙালি পাঠকের সমস্যাটা তো এ নিয়ে নয় যে, তিনি ছোটো, সরল বাক্যে লেখেন, না বড়ো এবং জটিল বাক্যে লেখেন! সমস্যাটা হলো, তিনি বাংলা অন্বয়ে বা ‘ইঙ্গ-বঙ্গ’ অন্বয়ে লেখেন কীনা আদৌ! আমরা জানি, কমলকুমার ফরাসী অন্বয়ে লেখা অভ্যাস করেছিলেন। সে জন্যই কতিপয় লোকের কাছে তাঁর আদর ছিলো, বাকিদের কাছে অনাদর। ব্রাত্য সেই কথাটাই বললেন না। যদিও মোদ্দা কথাটা ঠিকই বললেন, আমরা লেখক-কে বলে দিতে পারি না; ‘ডিক্টেট’ করতে পারি না।
কিন্তু সেই ব্রাত্য রাইসুর মনের গহনেও কী সংস্কার খচিত রয়েছে সেটাও দেখা যাক: আঙুল তুলে তিনি বলেন, ‘নজরুলকে বলতে পারবেন না, আপনি শুদ্ধ বাংলা ভাষায় লিখবেন, কোনো আরবি-ফার্সি শব্দ ব্যবহার করবেন না।’
সে তো বলা যায়ই না। কিন্তু ‘শুদ্ধ বাংলা’-টা কী ব্যাপার? খায়, না মাথায় দেয়? আরবি-ফার্সি শব্দ থাকলে সেটা অ- শুদ্ধ বাংলা হয়ে গেলো? রাইসু-র কি ধারণা, ‘শুদ্ধ বাংলা’ ব্যাপারটা আদতে সংস্কৃত? তিনি কি মনে করেন, ভাষার কোনো ‘শুদ্ধতা’ আদৌ হয়? শুদ্ধতা মানে তো এক অর্থে বর্বরতা, আমার এক শিক্ষক একদা বলেছিলেন। ভাষার জীবন-শক্তি তো তার মিশ্রিত চলায়। যত মেশে, ততো বেগ বাড়ে।
ঢাকা-র ‘বাংলা একাডেমী’র আইন প্রণয়ণের ইচ্ছা ফাশিস্ত। অন্যদিকে, ব্রাত্য রাইসু-র ভাষা-প্রয়োগেও এক ধরণের রাজনীতি বেশ ধরা যায়। সূত্রটা মোটামুটি এইরকম যে: সংস্কৃত > ব্রাহ্মণ্যবাদ > ‘ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদ’ > শুদ্ধ বাংলা বা প্রমিত বাংলা।
এটা ঠিক না ভুল, সেটা বিশদে বোঝানোর জন্য আমি বন্ধু গৌতম চৌধুরি-কে ডাকছি; তাঁর সঙ্গে মতের অমিল হতে পারে, জেনেও।
আমার উত্তর >>
জয়দেব, কমল কুমারে বা নজরুলে যে যা সমস্যা দেখে তাতে আমার অশ্রদ্ধা নাই। আমি সমস্যা নিয়া বলি নাই, আপত্তি নিয়া বলছি।
আমি বলছি লেখকদের প্রকরণাদি নিয়া যে কোনো ভাষী যে কোনো মানুষের যে কোনো আপত্তি ব্যাপারে। যে, এমন করে আপত্তি করা যায় না।
যেই বিষয়ে স…মস্যা সেই বিষয়ে আপত্তি এমন কিছু ছিল না আমার কথায়। ধরা যাক, কবি জয়দেব নিয়া বাঙালি পাঠকের সমস্যা যে তার কেন গৌর বর্ণ। আমি এই সমস্যায় শ্রদ্ধা রাখলাম। কিন্তু তারা আপত্তি করল কবি জয়দেব কেন চশমা পরে। ওই আপত্তি করা যায় না। সমস্যা বোধ করা যায়, সমস্যার লগে একাকারও হওন যায় বটে।
কমলকুমারে বাঙালি পাঠক জয়দেব কথিত সমস্যা দেখে বইলা ওই সমস্যা নিয়াই আপত্তি করবে তারা–বাপাদের এমন মিতাচারী ভাবার কারণ নাই ব্রাদার।
২.
“সংস্কৃত > ব্রাহ্মণ্যবাদ > ‘ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদ’ > শুদ্ধ বাংলা বা প্রমিত বাংলা”এই রকম আমি বলি নাই বা বোঝাই নাই। যা বলি নাই তা কীভাবে ধরা হইল দেখাইয়া দিলে ভালো হইত। ভারত দেশে খালি বাংলায় কথা বলে নাকি লোকে, আর খালি শুদ্ধ বা প্রমিত বাংলায়ই বলে নাকি!
শুদ্ধ বাংলার উৎস নিশ্চয়ই পশ্চিম বাংলা। শুদ্ধ বাংলা ভাষাটি ওইখান থিকাই আসছে। কিন্তু বাংলাদেশে শুদ্ধ ভাষা সাম্রাজ্যবাদকে ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদ থিকা আলাদা রাখা দরকার। হিন্দি দিয়া পশ্চিমবাংলার বাংলার রফা সারা হইলে ওইটারে ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদও বলা যাবে, ভাষা সাম্রাজ্যবাদও। বাংলাদেশে ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদী হিন্দি কাজ করে না। পশ্চিমবাংলায় করে নাকি?