প্রগতিশীল লেখকেরা কেন খারাপ?

প্রগতিশীল লেখকেরা কেন খারাপ? ~

পশ্চিমবাংলায় এবং এই দেশে মিডল ক্লাসের যে “নৈতিক অবস্থান” ধইরা রাখার প্রাণপন ব্যায়াম—যেইটারে আপামর শিক্ষিত সমাজ বলে “মূল্যবোধ রক্ষা”—তা তৈরি কইরা দিছে মূলত প্রগতিশীল লেখক, বুদ্ধিজীবী, অ্যাকটিভিস্ট, শিল্পী ও ফিল্মমেকাররা।

আমি এদের সকলকে “প্রগতিশীল লেখক” নামে ডাকতেছি। কেননা লেখা বা রচনা করার মাধ্যমেই এরা নিজেদের প্রগতিশীলতাগুলিরে আমাদের জীবনে প্রয়োগ করতে থাকতেছেন।

২.
প্রগতিশীল লেখক তারাই যারা ধর্মীয় সাহিত্য ও ধর্মীয় অনুশাসনের বাইরে থাইকা সাহিত্য ও সমাজ ইত্যাদি করেন। ধর্মের বিরুদ্ধে না, কিন্তু বাইরে থাকে তারা। আবার ধর্মের যে কর্তাগিরি, সেইটা পুরাই করায়ত্ত করতে চান।

এই ধরনের প্রগতিশীল লেখক বুদ্ধিজীবীদেরকে সাধারণ শিক্ষিত সমাজ ধর্মবিরোধী মনে কইরা একঘরে করতে পারে, এই রকম একটা সামাজিক ভয় তাদের মধ্যে কাজ কইরা থাকতে পারে।

যে কারণে নিজেদের লেখালেখির মাধ্যমে “ধর্মের লগে সাংঘর্ষিক না” বা দেখলে মনে হবে “ধর্মের বিরোধী না” এমন সব নীতি নৈতিকতাগুলির শিকড়ে তারা পানি ঢাইলা গেছেন আমৃত্যু, এবং এখনও কেউ কেউ ঢালতেছেন।

তারা কার্যত নীতি-লেখক বা নৈতিকতা রক্ষাকারী অ্যাকটিভিস্ট।

৩.
ধর্মের বিধিনিষেধরে সব ধর্মের লোকেরাই একটা পর্যায়ে গিয়া জীবনযাপনের মইধ্যে মিশাইয়া ফেলায়। তখন অনেকেই, ওইরকম কঠোর ভাবে বা মূল্যবোধ আকারে আর ধর্ম পালন করে না।

ভাবটা এই রকম—”ধর্ম তো আছেই” বা “যার যার ধর্ম তার তার কাছে”, ইত্যাদি। অর্থাৎ ধর্মীয় অনুশাসনগুলি যখন সমাজে গৃহীত হইয়া যায় তখন আর নিষেধাজ্ঞাগুলি অত প্রকট থাকে না। সমসাময়িক রাজনীতির বাইরে ধর্মরে আর ওইভাবে লক্ষ্যও করা যায় না।

৪.
ইতিহাসের একটা পর্যায়ে শিক্ষিত ও শিক্ষা নাই এমন সব শ্রেণীর মধ্যেই ধর্মীয় উপাচার বা উপাসনা ইত্যাদির প্রভাব কইমা প্রায় জিরোতে গিয়া পৌঁছায়। কয়েকশো বছর হইল যেই পর্যায়ে আমরা আছি।

এই সময়ে মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিকতা বা স্পিরিচুয়ালটির সংকট অর্থাৎ একলা হইয়া যাওয়ার ভয় বাড়তে থাকে।

প্রতিক্রিয়া হিসাবে কিছু মানুষ পুরাতন ধর্মের নিষেধাজ্ঞাগুলিরে জোরেশোরে সামনে আনার চেষ্টা করে। কিছু মানুষ নতুন নিষেধাজ্ঞার সন্ধান করতে থাকে।

এই শেষোক্ত কিছুরাই হইতেছে প্রগতিশীল গোষ্ঠী।

৫.
মানুষের ধর্মশূন্য বা ধর্মীয় উপাচারহীন জীবনে অর্থ বা মূল্য তৈরি করার যে হাহাকার সৃষ্টি হয়, প্রগতিশীল লেখকেরা নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা ও অভাব বোধ থিকা ওই ফাঁক পূরণে আগাইয়া আসে।

তারা নতুন সব আলো কিংবা নিষেধাজ্ঞা আবিষ্কার করে এই সময়টায়। তাদের উদ্ভাবিত নৈতিক নিষেধাজ্ঞাগুলি ধীরে ধীরে সমাজে ধর্মের জায়গা দখল করতে তৎপর হয়।

এবং তাদের এই “না”গুলি যেহেতু নবীন বা কাঁচা তাই এগুলি ধর্মের চাইতে কঠোর ও উচ্চকিত হইয়া থাকে।

ধর্ম যেই সমস্ত আচরণ বা স্খলনের ব্যাপারে আলাদা কঠোরতা প্রদর্শন করে না, প্রগতিশীল লেখক অ্যাকটিভিস্ট ইত্যাদি লোকেরা সেগুলিরেও মূর্তিমান ও প্রায় শাস্তিযোগ্য নিষেধাজ্ঞা আকারে সামনে নিয়া আসে।

তারা পরকালে শাস্তি দেওয়ার বদলে নিজকালেই যুথবদ্ধ ভাবে বয়কট, মামলা, অর্থনৈতিক বা পেশাগত অসহযোগিতা, অবজ্ঞা, গণ ঘৃণা, গণ অসম্মান ইত্যাদি নানা প্রকার শাস্তির ব্যবস্থা করে।

যেহেতু স্রেফ কিছু আচার পালন কইরাই এই নতুন নৈতিকতারে আপনি সন্তুষ্ট করতে পারবেন না, তাই এইটা সজ্জিত থাকে ধর্মের শুরুর সময়কার মতো নানান ভারি ভারি নিষেধাজ্ঞা দিয়া, আপনারে সে নানা রকম “না” করতে থাকে।

৬.
প্রগতিশীল লেখকেরা খারাপ কারণ তারা আমাদের ওপর আরো আরো মূল্যবোধের বস্তা চাপাইতে চায়। তারা চায় নতুন ধর্মের প্রবর্তন, যেইটা পশ্চিম থিকা আইছে—তবে এখনো ওই রকম শেইপ নেয় নাই, নাম নেয় নাই—তাতে দীক্ষিত করতে।

আমাদের এমনিতেই অনেক ধর্ম, নতুন ধর্মের আর দরকার নাই!

১৪/৯/২০২২

Leave a Reply